পার্বত্যাঞ্চলের পর্যটন নিয়ে দেশে এবং বিদেশে ভাবনার বিশেষ একটি জায়গা গড়ে উঠেছে ইদানীং। বিশেষ করে পার্বত্য শান্তিচুক্তি’র পর নানা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে পর্যটনকে নানাভাবে উপস্থাপনের একটা প্রচেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অথচ এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার সাথে পার্বত্য এলাকার তৃণমুল জনগোষ্ঠির আরো ভালো যোগাযোগ গড়ে উঠতে পারতো। যেকোন দেশের পর্যটনের সাথে ওই এলাকার বসবাসরত মানুষের সংস্কৃতি-লোকজ বিশ্বাস-স্থানীয় আইন-কানুন এবং অর্থনৈতিক ও শিক্ষাগত সক্ষমতার বিষয়টি ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত।
‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ উত্তর কয়েক দশকে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন নিয়ে সরকার-দাতাসংস্থা এবং বেসরকারী উদ্যোক্তাদের বিভিন্নমুখী পদক্ষেপের ফলে পর্যটন তথা মানব বিনোদনের দৈনন্দিন অনুষঙ্গগুলো; বলা চলে ভালোই বিকশিত হয়েছে। কিন্তু এই বিকাশমানতার সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠির খুব একটা কার্যকর পরিচিতি গড়ে উঠেনি। ফলে যে অর্থে নতুন একটি শিল্পখাত গড়ে উঠার কথা; সেভাবে পর্যটন পাহাড়ে জায়গা করে নিতে পারেনি।
বিশেষ করে ধর্মীয় ও জাতিগত বহুত্বসম্পন্ন জনপদ এবং প্রকৃতি সংবেদনশীলতার ভাবনা থেকে তিন পার্বত্য জেলায় পর্যটন শিল্প বিকাশের একটি দীর্ঘমেয়াদী চিন্তাভাবনার আগে একটি গ্রহণযোগ্য সামাজিক সমীক্ষা হওয়া সমীচিন। যাদের জন্য, উন্নয়নের এই নতুন নিরীক্ষা; তাঁদের অংশগ্রহণ এবং ভবিষ্যত অংশীদারিত্ব কতোটা স্থায়িত্বশীল, তা ভেবে দেখা সর্বাগ্রে প্রয়োজন। এখনো পাহাড়ের পর্যটন বিকাশে নীতিকাঠামো নির্ধারণের বিষয়টি অগ্রাধিকার পাবার দাবী রাখে।
যেসব বিষয় প্রাধান্য পেতে পারেঃ
একটি আঞ্চলিক পর্যটন নীতিমালা প্রণয়ন, তিন পার্বত্য জেলার পর্যটন নিয়ে একটি স্বতন্ত্র গ্রহণযোগ্য পর্যটন কর্তৃপক্ষ গঠন, বিদ্যমান পর্যটনস্পট গুলোর সংরক্ষণ এবং বিকাশে নেপাল ও ভারতের সেভেন সিস্টারের আদলে “কমিউনিটি ট্যুরিজম” প্রকল্প গ্রহণ, “হোম বেইসড্ ট্যুরিজম”-কে পরিচিত করে তোলা। যেটির মাধ্যমে পার্বত্য এলাকার সর্ব-সাধারণ মানুষ এই শিল্পকে একটি সংস্কৃতিবান্ধব উপায়ে গ্রহণ করতে পারেন।
পাহাড়ের বহুল পরিচিত পর্যটন এলাকাগুলোকে স্থানীয় জনগণের মালিকানা অথবা সরকার (সরকারি বিভাগ) ও জনগণের যৌধ মালিকানা স্বীকার করে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা। এসব এলাকায় বংশ পরম্পরায় বসবাসরত জনগোষ্ঠির হাতে সরকারী বিধিবদ্ধ নিয়মে পর্যটনস্পট গুলোর ব্যবস্থাপনা অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করা গেলে হাজার বছর ধরে ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য-পরিবেশগত ভারসাম্য-নান্দনিকতা এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ সুরক্ষিত হবে।
সরকারী বা বেসরকারী বিনিয়োগের যেকোন ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় জনগণের লোকায়ত জ্ঞানকে কাজে লাগানোর সদিচ্ছা। ব্যয়বহুল উন্নয়ন পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকার কাঠামোর মাধ্যমে “পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি)”-টাইপের প্রকল্প গ্রহণ পর্যটন উন্নয়নের নামে কোন পর্যটন এলাকায় বসবাসরত জনগণকে উচ্ছেদ না করে তাঁদেরকে প্রয়োজনীয় সচেতনতা এবং সুযোগ প্রদানের মাধ্যমে পর্যটনকেন্দ্রীক মানব সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা। এই একটিমাত্র ভুল বোঝাবুঝির কারণে খাগড়াছড়ির আলুটিলায় ‘এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র অর্থায়নের একটি বিশেষ প্রকল্প শেষতক আলোর মুখই দেখেনি।
পর্যটন বিকাশে সরকারী অনুদানের পাশাপাশি এলাকার সামর্থ্যবান উদ্যোক্তা অথবা আগ্রহী বিনিয়োগকারীদের বিশেষায়িত পর্যটন কর্তৃপক্ষ বা সংবিধিবদ্ধ স্থানীয় সরকার কাঠামো (আঞ্চলিক পরিষদ-পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড-পার্বত্য জেলা পরিষদ-পৌরসভা-ইউনিয়ন পরিষদ)-র মাধ্যমে অংশগ্রহণের উন্মুক্ত সম-সুযোগ প্রদান। শেষকথা হিসেবে বলতে চাই, যাঁরা পর্যটন শিল্প বিকাশের আশায় তিন পার্বত্য জেলায় হোটেল-মোটেল গড়ে তুলছেন; তাঁদের অর্থনৈতিক বিনিয়োগের নিরাপত্তা এবং সরকারীভাবে প্রণোদনামুলক পদক্ষেপ গ্রহণের আশাও জাগাতে হবে, সরকারকে।
প্রদীপ চৌধুরী: পাহাড়ের সংবাদকর্মী।