পাহাড়ের দুর্গম ও প্রত্যন্ত জনপদে শিক্ষার মানোন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রেখে আসছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও ইউনিসেফ কর্তৃক পরিচালিত পাড়াকেন্দ্র গুলো।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামে ৪ হাজার ৮০০টি পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে প্রায় আড়াই লাখ জনগোষ্ঠীকে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য, পুষ্টি উন্নয়ন, নিরাপদ পানি সরবরাহ, পয়ঃব্যবস্থা উন্নয়ন, সংক্রমক ব্যাধি, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম ও নির্যাতন প্রতিরোধসহ নানা সামাজিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে।
প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি নানা মৌলিক সেবাও পৌঁছে দিচ্ছে পাড়াকেন্দ্র। পাহাড়ে রয়েছে পাহাড়ি বাঙালি জনগোষ্ঠীর বসবাস।
এসব জনগোষ্ঠীর শিশুদের নিজেদের মাতৃভাষার পাশাপাশি খেলাধুলার মাধ্যমে বাংলা ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার কাজ করছে পাড়াকেন্দ্র।
নিজেদের ভাষার পাশাপাশি এসব শিশুদের দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য জানাতে এবং নানাবিধ মৌলিক সুবিধা প্রদানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্পের আওতায় শুরু হয়েছিল এই পাড়াকেন্দ্র।
যেসব এলাকায় এখনো পর্যন্ত কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে উঠেনি সেসব জায়গায় এই প্রকল্পের মাধ্যমে পার্ত্যাঞ্চলের শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। এসব কার্যক্রমে খুশি সেসব এলাকার বাসিন্দারা। কিন্তু বাস্তবায়নকৃত এই প্রকল্পটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। প্রকল্প কার্যক্রমের ভবিষ্যৎ নিয়ে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়েছে।
২০২৩ সালের ৩০ জুন এই প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে কর্মরত পাড়াকর্মীরা ৩মাস ধরে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। চাকুরী কার্যক্রম চালু থাকলেও বেতন-ভাতা না পাওয়াতে সীমাহীন আর্থিক সংকটে দিন কাটছে রাঙামাটির লংগদু উপজেলার ২১৪ পাড়ার ২৩৫টি পাড়াকর্মীর পরিবারের।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, লংগদুতে ২৩৫টি পাড়া কেন্দ্রে দুই হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। যারা সকলেই দুই বছর মেয়াদি শিক্ষাবর্ষের ৩-৬ বছর বয়সী। তাদের পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে শিখানো হতো প্রায় ৩৪টি যোগ্যতা। পাড়াকেন্দ্রের মাঠ সংগঠক অঞ্জনা চৌধুরী বলেন, আমরা মূলত এই পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মীদের মাধ্যমে দুর্গম এলাকাগুলোতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি বিষয়ক সেবাগুলো প্রদান করে থাকি।
পাশাপাশি আমরা বাড়ি পরিদর্শন ও উঠান বৈঠকের মাধ্যমে নারী ও কিশোরীদের স্বাস্থ্য বিষয়ক পরামর্শ দেই। তিনি আরও বলেন, আমরা উঠান বৈঠকে এলাকার প্রসূতি, গর্ভবতী ও কিশোরীদের অংশগ্রহণ করানোর সঙ্গে শিশুদের অভিভাবকদেরও রাখি। বৈঠকে আমরা স্বাস্থ্য, পুষ্টি ও শিশু সুরক্ষা এই তিনটি বিষয়ের ওপর খুব জোর দেই। স্বাস্থ্যের মধ্যে টিকা দেওয়া, নিয়মিত চেকাপ করানো, পুষ্টির মধ্যে সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং শিশু সুরক্ষার মধ্যে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, টিকা দেওয়ার বিষয়গুলো নিশ্চিত করার চেষ্টা করি। এলাকার অনেক কিশোরী এই পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য বিষয়ে সঠিক তথ্য পাচ্ছে। ভূক্তভোগি পাড়াকর্মীরা জানান, জুলাই মাস থেকে তাঁরা বেতন পাচ্ছেন না।
পাড়াকর্মীদের অধিকাংশ পরিবার দরিদ্র। পাড়াকেন্দ্রের বেতনটুকু তাদের পরিবারের সহায়ক। কিন্তু তিনমাস বেতন না পাওয়াতে সংকটে রয়েছেন তাঁরা। এদিকে বেতন-ভাতা বন্ধ থাকলেও পাড়াকেন্দ্রের কার্যক্রমও চালু রয়েছে। ফলে, যথা নিয়মে পাড়া কেন্দ্রে তাদের সময় দিতে হচ্ছে। মুসলিম ব্লক পাড়াকেন্দ্রের পাড়াকর্মী নূর আক্তার জানান, তিনমাস বেতন না পাওয়ার কারণে স্বজনদের থেকে ধার-কর্জ করে কোনমতে সংসার চালাচ্ছেন, সন্তানদের প্রাইভেট বেতন দিতে পারছেন না। উপজেলার
মাইনীমূখ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান কামাল হোসেন কমল বলেন, আমরা পাড়াকেন্দ্রের মাধ্যমে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টি বিষয়ক নানান সুবিধা পাচ্ছি। পাশাপাশি পাড়াকেন্দ্র শিশু কিশোরদের জন্ম নিবন্ধন তৈরিতেও আমাদের সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। তাই সরকারের কাছে আমার দাবি, এই প্রকল্পটির মেয়াদ বৃদ্ধি করে প্রকল্পটি চলমান রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
জানতে চাইলে টেকসই সামাজিক সেবা প্রদান প্রকল্প (২য় পর্যায়) উপজেলা প্রকল্প ব্যবস্থাপক ওয়াসিল রায়হান জানান, বরাবরের মতো আবার নতুন প্রকল্প হিসেবে ডিপিডি (ডিমান্ড প্রজেক্ট প্রোগ্রাম) জমা দেওয়া হয়েছে। এখন উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ চূড়ান্ত অনুমোদন দিলেই বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য পরিকল্পনা জসিম উদ্দিন বলেন, এই প্রকল্পটি যাতে চলমান থাকে সেজন্য আমরা ইতোমধ্যে ডিপিপি তৈরি করেছি, যা আমরা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়ে দেবো। আমি বিশ্বাস করি, সরকার এটাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হিসেবে গ্রহণ করবে এবং প্রকল্পটি পাস করবে।
প্রকল্পটি পাস হলে আমরা আগের মতোই প্রকল্পটিকে চলমান রাখতে পারব। প্রসঙ্গত, পাড়াকেন্দ্রে শুধু প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাই প্রদান করা হয় না, ছেলে-মেয়েদের নিয়ে এখানে উঠান বৈঠক করা হয় নিয়মিত। একজন শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য তৈরি করে এই পাড়াকেন্দ্র। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণি থেকে দ্বিতীয় শ্রেণির শিশুরা যা পড়ে, তা পাড়াকেন্দ্রেই শিশুদের নিজেদের মাতৃভাষার মাধ্যমে পাড়ানো হয়।
এতে শিশুদের মধ্যে স্কুল ভীতি আর থাকে না এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাটা সহজতর হয়ে ওঠে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা প্রদানের পাশাপাশি কিশোরী এবং নারী স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কাজ করে পাড়াকেন্দ্র। উঠান বৈঠক, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে এসব মৌলিক সুবিধা প্রদান করেন পাড়াকেন্দ্রের মাঠ সংগঠক ও পাড়াকর্মীরা।