বন্যা, অবৈধ বালু উত্তোলন ও পরিবহনের ফলে রাঙামাটি জেলাস্থ বাঘাইছড়ি পৌরসভার বেশিরভাগ সড়কের অবস্থাই বর্তমানে খুবই করুণ দুর্বিষহ অবস্থায় পতিত হয়েছে। বিশেষ করে পৌরসভার ১নং ওয়ার্ডের মাষ্টার পাড়ার সড়ক যেন বর্তমানে মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। গত ৩ মাসে বাঘাইছড়ি উপজেলায় চারবার ভয়াবহ বন্যার কারণে সড়কটির পিচের আস্তরণ উঠে গিয়ে গভীর গর্তে পরিণত হয়েছে। বর্তমানে সড়কটি কার্যত চলাচলের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে পৌরসভার অধিকাংশ সড়ক’র বর্তমানে বেহাল দশা। সামান্য একটু বৃষ্টি হলেই এসব খানাখন্দে ভরা সড়ক তলিয়ে যায় পানিতে। এসব সড়কে মাঝে মধ্যেই ঘটছে দুর্ঘটনা। তখন মানুষের দুর্ভোগের আর সীমা থাকে না। সামান্য বৃষ্টিতে সড়কে জমে থাকে পানি। পায়ে হেঁটে চলাচল করতেও ভোগান্তিতে পড়তে হয় পথচারীদের।
অবৈধ বালু উত্তোলন এবং ভারী যানবাহনের অবাধ চলাচল সড়কের অবস্থা আরও নাজুক করেছে। এসব কারণে রাস্তায় সৃষ্টি হয়েছে বড় বড় গর্ত ও উঁচু-নিচু অংশ, যা যাতায়াতকারী যানবাহন এবং পথচারীদের জন্য মারাত্মক ঝুঁকি তৈরি করেছে। এটি কেবলমাত্র একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং মানুষের অদক্ষতা ও অবৈধ কর্মকাণ্ডেরও ফলশ্রুতি বলে মনে করছেন স্থানীয় জনসাধারণ।
সরেজমিনে পরিদর্শন করতে গিয়ে দেখা যায়, উপজেলার কাচালং নদীতে প্রায় ১৫টিরও অধিক ড্রেজার মিশিন বসিয়ে যে যার ইচ্ছে মত বালু উত্তলন করছে। কিন্তু কারও যেন কিছু বলার নেই। এই বালু উত্তলনের কারণে একদিকে যেমন নদী ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে অন্যদিকে উত্তলনকৃত এই বালু অদক্ষ ডাম্পার ট্রাক চালক দিয়ে পরিবহনের ফলে পথচারীদের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। ড্রেজার দিয়ে নদী থেকে যত্রতত্র বালু উত্তোলনের ফলে পানিদূষণসহ নদীগর্ভের গঠনপ্রক্রিয়া বদলে যাচ্ছে এবং নদী ভাঙছে। সেই সাথে নদীর তীরবর্তী গ্রামের মানুষের বসতভিটা ও আবাদি জমি প্রতিনিয়ত ভাঙ্গনের সম্মুখীন হচ্ছে। পুরো হাইড্রোলজিক্যাল কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বালু উত্তোলনের কাছাকাছি মাটির ক্ষয় যেমন ঘটছে, তেমনি মাটির গুণাগুণও নষ্ট হচ্ছে। সেই সাথে উত্তোলিত এই বালু পরিবহনের জন্য ব্যবহৃত ডাম্পার ট্রাকগুলো ২৯০ থেকে ৩৫০ ফুট অবৈধ বালু পরিবহন করায় সড়কের ওপর মারাত্মক চাপ সৃষ্টি করছে। সড়কের ওপর এই ভারী যানবাহনের চাপের কারণে সড়কের মাটি ক্ষয় এবং সড়কের মধ্যে অসংখ্য গর্ত ও উঁচু-নিচু অংশের সৃষ্টি হয়েছে। বারংবার সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল ও অবৈধ বালু উত্তোলনের কালো থাবায় দুর্বিষহ অবস্থার পড়েছে পৌর বাসী। বিশেষ করে পুরাতন মারিশ্যা ও মাষ্টার পাড়া সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে ওই এলাকায় হাজারো মানুষ দুর্বিষহ অবস্থায় রয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, প্রশাসন এবং স্থানীয় সরকারের পক্ষ থেকে এই সমস্যা সমাধানে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বন্যার পরবর্তী মেরামতের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি এবং অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
এক নং ওয়ার্ডের স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুল ওয়াদুদ ও জাহাঙ্গীর আলম বলেন, সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে আমরা খুব কষ্টের মধ্যে রয়েছি। বর্তমানে বড় বড় ভারী ড্রাম ট্রাক চলাচলের ফলে রাস্তার আরও বেশী ক্ষতি হয়েছে কারণ বন্যা পরবর্তী সময়ে রাস্তার অবস্থা এমনিতেই অনেক নাজুক ছিলো। এখনত এই রাস্তা দিয়ে চলাচল করাটা অনেকটাই কষ্ট সাধ্য হয়ে পড়েছে। আমাদের ছেলে-সন্তান স্কুলে পাঠানো যায়না, মাদ্রাসায় পাঠানো যায়না যে হঠাৎ কোন সময় তারা দূর্ঘটনার শিকার হয়। এই জন্য জরুরী ভিত্তে এই রাস্তার কাজ করা এবং পাশাপাশি সকল ধরনের অবৈধ কার্যক্রম বন্ধ করা দরকার হয়ে পড়েছে।
এসময় পথচারী রবি বলেন, এই সড়ক দিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গাড়ি আটকে যাচ্ছে যেমন বড় বড় ড্রাম ট্রাক, সিএনজি, মোটরসাইকেল। রাস্তাটা এতটাই খারাপ হয়েছে যে ভাষায় প্রকাশ করার মত না। প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে অনেক গাড়ি আটকে যাচ্ছে সড়ানো যাচ্ছে না। গত ২ দিন আগেও রাত ৮টার দিকে একটি গাড়ি রাস্তায় সৃষ্ট খাদের মধ্যে আটকে গেলে পরেরদিন সকালে অন্য একটি গাড়ি এসে তাকে উদ্ধার করে। এমতাবস্থায় সড়কটি যদি অতি শীঘ্রই মেরামত করা নাহয় তাহলে হয়তোবা সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
মাষ্টার পাড়ার স্থায়ী বাসিন্দা মো: ইমরান হোসেন বলেন, আমাদের এলাকায় ছোট রাস্তা দিয়ে অবৈধ ভাবে বালু বোঝাই করে যে বড় বড় ড্রাম ট্রাকগুলো চলাচ্ছে এটার জন্যই মূলত ছোট বড় খাদের সৃষ্টি হয়েছে। জনজীবনে বাধার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী সহ অসুস্থ, বৃদ্ধ, নারী -পুরুষ প্রত্যকেই এই সমস্যা ও ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে।
স্কুল পড়ুয়া খাদিজা নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বালু বহনকারী গাড়ির জন্য আমাদের স্কুলে যেতে অনেক কষ্ট হয় তারা অনেক উচ্চ গতিতে গাড়ি চালায়। তাই শুষ্ক মৌসুমে স্কুলে যাওয়ার সময় আমরা ধুলা-বালুর জন্য ঠিক মত শ্বাসও নিতে পারিনা আবার বর্ষা মৌসুমে কাদার জন্য রাস্তা দিয়ে স্কুলে যেতে অনেক কষ্ট হয়। গত বর্ষায় ত একদিন আমি স্কুলে যাওয়ার পথে একটি বালুর গাড়ি অনেক গতিতে আমাকে অতিক্রম করে যায় ফলে রাস্তার কাদাগুলো আমার স্কুল ড্রেসে এসে পড়ায় আমি আর ওইদিন স্কুলে যেতে পারিনি।
বাঘাইছড়ি পৌর প্রশাসক ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) রেদওয়ান ইসলাম বলেন, আমি পৌর প্রশাসক হিসেবে নতুন দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। তাই পৌরসভার সার্বিক বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করছি। বর্তমানে আমাকে দুইটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে। আর দেশের এই পরিস্থিতিতে সড়কগুলো মেরামত করা কিছুটা সময় সাপেক্ষ। বর্তমানে বর্ষা মৌসুম, কিছুদিন আগেই বন্যা হয়েছে। রাস্তা-ঘাট এখনো পানিতে ভিজে আছে। তবে যে সড়কগুলো একদম চলাচলের অনুপযোগি হয়ে পড়েছে তা আমরা নিজ উদ্যোগে হয়তো কিছুটা চলাচলের উপযোগী করে দিতে পারি। তাছাড়া অবৈধ বালু উত্তলন নিয়েও আমাদের কাছে তথ্য রয়েছে। গত আইন-শৃঙ্খলা সভায়ও এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের কথা হয়েছে। বিষয়টা আমরা কঠোর নজরদারিতে রাখছি।