পতিত ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের আগে সারাদেশে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ছিলো এক আতঙ্কের নাম। সারাদেশের মতো রাঙামাটিতেও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ছিল আরেক আতঙ্ক। চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও নৈরাজ্যের অভিযোগ ছিল সংগঠনটির বিরুদ্ধে। এবার সেই ছাত্রলীগের টর্চার সেলের সন্ধান মিলেছে রাঙামাটির আলম ডক ইয়ার্ড এলাকায়। কথিত আয়না ঘর বা টর্চার সেলে নিয়ে ব্যবসায়ি, শ্রমিক থেকে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতো আর চাঁদা না দিলে চলতো অমানসিক নির্যাতন। এলাকাবাসী ও ভূক্তভোগীরা ছাত্রলীগের এসব চাদাঁবাজ, সন্ত্রাসী গ্যাংদের অবিলম্বে গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন। তবে পুলিশ বলছে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। টর্চার সেলটি অবস্থান আলম ডগ ইয়ার প্রবেশ পথে (মেইন রোডের পাশে) সাবা টাওয়ারের নিচতলা।
ফ্যাসিষ্ট আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের আগে রাঙামাটি শহরের আলম ডক ইয়ার্ড এলাকায় নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ব, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী ও প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠে এলাকাবাসী। তৎকালিন সময়ে তাদের ভয়ে এলাকাবাসী কেউ মুখ খুলতে চাইতেন না। অভিযোগ রয়েছে জেলা ছাত্রলীগের (সাবেক) সহ-সভাপতি হাবিবুর রহমান বাপ্পীর নেতত্বে জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার হোসেন কায়সার (বর্তমানে জেলাহাজতে আছেন), ছাত্রলীগ নেতা মোঃ রাব্বী ও মোঃ রাকিব চাঁদা আদায়ে আমানসিক নির্যাতন চালাতেন। জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ শাওয়াল উদ্দিনের দিকনির্দেশনায় সন্ত্রাসীকার্যকলাপ ও চাঁদাবাজি করতো। পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর থেকে শাওয়াল উদ্দিন রয়েছেন পলাতক।
রাঙামাটি শহরের আলম ডক ইয়ার্ড এলাকায় ৬তলা ভবনের নিচতলায় একটি কক্ষে টর্চার সেল বানিয়ে ছাত্রলীগের এই সন্ত্রাসীরা স্থানীয় ব্যবসায়ি, ভবন মালিক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করতো। চাঁদা না দিলে কথিত এ আয়না ঘরে নিয়ে অমানসিক নির্যাতন চলাতো তারা। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ জিম্মি হয়ে থাকতো। যারা প্রতিবাদ করার চেষ্টা করতেন তাদেরকেও জানে মেরে ফেলার হুমকি ধমকি দিতো। শুধু চাঁদাবাজি নয় তারা স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের ইভটিজিং, প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি, গ্যাংদের নিয়ে আড্ডাবাজি, সীমান্ত পথ ব্যবহার করে ভারতীয় সিগারেট বিক্রিসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিলেন। তবে বর্তমানে তারা পলাতক রয়েছেন। এলাকাবাসী ও ভূক্তভোগীরা নিষিদ্ধ এ ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।
টর্চার সেলের বর্ণনা দিয়ে ভ্যান চালক শ্রমিক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, আমি মাশরুম কেরিং করি। ছাত্রলীগ নেতা মোঃ রাব্বী, হাবিবুর রহমান ও মোঃ রাকিবসহ আরো কয়েকজন মিলে আমাকে টর্চার সেলে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে আমাকে মারধর করে এবং ৪লক্ষ টাকা চাঁদা দাবি করে। অন্যথায় আমি রাঙামাটি শহরে থাকতে পারবো না। পরে আমি নিরুপায় হয়ে নিজ বাড়ি বাঘাইছড়ি থেকে জমি বিক্রি করে তাদেরকে চাঁদার টাকা পরিশোধ করি। এসবের নেতৃত্বে ছিলেন, জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ শাওয়াল উদ্দিনগংরা।
মুর্দি দোকানদার আব্দুল হক ও বাড়ির মালিক বদিউল আলম বলেন, আমি সাধারণ একজন মুর্দি দোকানদার হয়ে প্রতিনিয়ত চাঁদা দিতে হয় এসব ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীদের। যার কারনে ২০২৪ সালের শেষের দিকে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হই। বদিউল আলম বদি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমরা যখন পাকা ভবন তৈরি করি তখন এই সব ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা আমাদের কাছে চাঁদা চায় কিন্তু আমরা চাঁদা দিতে অপারগতা স্বীকার করলে আমাদের সামান্য জমি তারা কেড়ে নিয়ে যায়। তৎকালিন সময়ে আমরা কোথায়ও বিচার পাইনি। এখন সুযোগ এসেছে বিচার চাওয়ার তাই আমরা এসব চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে সরকারের প্রতি উদ্ধাত্ত আহবান জানাই। এসব চাঁদাবাজরা জেলা স্বেচ্ছাসেবক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মোঃ আওয়াল উদ্দিনের নেতৃত্বে চাঁদাবাজির সহায়তা করতেন।
ভবন মালিক আব্দুল করিম ও কলিমুল্লাহ বলেন, ২০২৪ সালে আমি নতুন ভবন নির্মাণ করার সময় আমার শ্রমিকদের তুলি নিয়ে যায় ছাত্রলীগ চাঁদাবাজরা। ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীরা পরে আমার শ্রমিকদের ডেকে নিয়ে তাদের কাছ থেকে মোবাইলসহ টাকা পয়সা ছিনিয়ে নেয়। পরে আমার কাছে ৩হাজার টাকা চাঁদা দাবি করে আনোয়ার হোসেন কায়সারগংরা।
আলম ডক ইয়ারের সমাজ উন্নয়ন কমিটির সদস্য জায়নাল আবেদীন ঝুনু ও কামাল হোসেন বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ বিগত দিনে আলম ডক ইয়ারের নরকীয় কর্মকান্ড চালিয়েছে। যা আপানাদেরকে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না। এসব ছাত্রলীগ নামধারীদের কাজ ছিল কিভাবে চাঁদাবাজি করবে। রীতিমত তারা এলাকায় ত্রাস সৃষ্টি করে ফেলেছে। কেউ কিছু বলতেও সাহস পাচ্ছিলনা। আমরা তাদের অপকর্মের সুষ্ঠু বিচারসহ গ্রেফতারের দাবি জানাই।
সাবা টাওয়ারের মালিকের শ্বশুর (বাড়ি বাঘাইছড়ি মারিশ্যা) আব্দুল মান্নান কোম্পানী বলেন, আমি এই ভবন নির্মাণ করতে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের ধাপে ধাপে প্রায় ১০লক্ষ চাঁদা দিতে হয়েছে। কারন চাঁদা না দিলে তারা আমাকে কাজ করতে দিচ্ছে না। তারা এভাবে অনেক জনের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করেছে। তৎকালিন সময়ে বিচার দেওয়ার জায়গা ছিল না। সবকিছু নিয়ন্ত্রণে ছিল আওয়ামী ছাত্রলীগের কব্জায়।
স্থানীয় সচেতন মহল বলেন, আমরা শুধু আলম ডক ইয়ারের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের কথা শুনে অবাক হলাম। গোটা রাঙামাটিতে যে সকল চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করেছে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ তার বর্ণনা দিয়ে শেষ করা যাবে না। জেলার ১০উপজেলায় ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের লোকজন সীমাহীন চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, টেন্ডারবাজি, জমি দখল, চাকরি বাণিজ্য, বদলী বানিজ্যসহ বিভিন্ন অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সার্বিক) মারুফ আহম্মেদ, দেশ ব্যাপী আইন-শৃঙ্খলা সমন্নুত রাখার জন্য বিশেষ অভিযান চলছে। এরই ধারাবাহিকতায় রাঙামাটিতেও বিশেষ অভিযান চলমান অবস্থায় বিভিন্ন আসামী গ্রেফতার ও তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা দায়ের করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে এসব সন্ত্রাসী ও চাদাঁবাজরা এলাকায় ত্রাস ও অশান্তি সৃষ্টি করতে না পারে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী তার যথাযথ পদক্ষেপ নেবে এটাই সবার আশা ও প্রত্যাশা।