পাহাড়ি অঞ্চলের সকালগুলো নিজস্ব ছন্দে জেগে ওঠে—রোদ ঝলমলে আলো, কুয়াশার আস্ত অবশিষ্ট পর্দা, আর সবুজ পাহাড়ের নীরবতা যেন মিলেমিশে তৈরি করে এক বিশেষ আবহ। এমনই এক প্রাতঃকালে দেখা মেলে তিনজন পরিশ্রমী মানুষের; তাদের শান্ত পদচারণায় ফুটে ওঠে পাহাড়ি জীবনের অনবদ্য কর্মযজ্ঞ, সংগ্রাম, এবং অসীম দৃঢ়তা।
কারও পিঠে বুনো জ্বালানিকাঠে বোঝাই ঝুড়ি, কারও কাঁধে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর ভারী বস্তা—তবু কেউই পিছিয়ে নেই জীবিকার পথে। পাহাড়ের খাড়া ও আঁকাবাঁকা রাস্তায় প্রতিদিন কয়েক কিলোমিটার পথ হেঁটে বাজারে যাওয়া বা পণ্য বহন করা তাদের জীবনের স্বাভাবিক অংশ। ক্লান্তি তাদের কাছে যেন এক বিলাসিতা; দায়িত্ব আর পরিবারই তাদের প্রেরণা।
স্থানীয় অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি এই পরিশ্রমীরা পাহাড়ি অঞ্চলের গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখতে বড় ভূমিকা রাখে এই শ্রমজীবী মানুষজন। বাজারে জ্বালানিকাঠ, বাঁশ, সবজি, ফল বা পাহাড়ি উপজাতির নিজস্ব পণ্য পৌঁছে দেওয়ার কাজটি মূলত তাদের হাতেই। পর্যটন বাণিজ্যের প্রসারেও তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে—পাহাড়ি রাস্তায় দোকান, হোমস্টে, ছোটখাটো কৃষিকাজ—সবকিছুই এগিয়ে নিচ্ছে এই পরিশ্রমী জনগোষ্ঠী।
স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, পাহাড়ি এলাকার প্রায় ৬০–৭০% পরিবার দৈনিক শ্রমনির্ভর কাজে জড়িত, এবং এসব কাজের বেশিরভাগই পাহাড়ি পথ বেয়ে যাতায়াতের ওপর নির্ভরশীল।
যাতায়াতের চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে এগিয়ে চলা পাহাড়ি রাস্তাগুলোর অধিকাংশই এখনো কাঁচা বা আধা-পাকা। বর্ষা মৌসুমে এসব পথ আরও বিপদজনক হয়ে ওঠে। অনেক সময় ভাঙন বা ভূমিধসের কারণে রাস্তা বন্ধও হয়ে যায়। তবু থেমে থাকে না তাদের জীবনযাত্রা। নিজেদের দক্ষতা এবং প্রকৃতিকে বুঝে চলার ক্ষমতাই তাদের মূল শক্তি।
এক পরিশ্রমী নারী শ্রমিক বলেন—“আমাদের জীবন কঠিন, কিন্তু কাজের প্রতি ভালোবাসা আমাদের ক্লান্ত হতে দেয় না। পরিবারকে হাসিমুখে দেখতে পারলেই সব কষ্ট ভুলে যাই।”
প্রকৃতির সঙ্গে মিশে থাকা এক শান্ত জীবন এ অঞ্চলের মানুষের জীবন প্রকৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য। পাহাড়ের ঢালে গড়ে ওঠা চাষাবাদ, বাঁশঝাড়, ঔষধি গাছ, পাহাড়ি নদী—সবই তাদের দৈনন্দিন জীবনের অংশ। বন্যফুলের সুগন্ধ, পাখির ডাক, আর উঁচুনিচু পথ বেয়ে চলার ছন্দ—এই সব মিলে তাদের জীবনকে আরও সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় করে তোলে।
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের রঙ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য আজও জীবন্ত—খাদ্যাভ্যাস, পোশাক, উৎসব, বাঁশের তৈরি ঘর ও হস্তশিল্প—সবকিছুতেই ফুটে ওঠে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য।
পর্যটকরা এই সৌন্দর্য দেখতে দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসেন। আর এই পরিশ্রমী মানুষগুলোই প্রত্যক্ষভাবে পর্যটন অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেন। উন্নয়নের পথে নতুন উদ্যোগ সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় প্রশাসন পাহাড়ি রাস্তাগুলো সংস্কার, বিকল্প জীবিকায় প্রশিক্ষণ এবং নারীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি করতে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এসব উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর জীবনমান আরও উন্নত হবে—যা ইতিমধ্যেই অঞ্চলে আশার সঞ্চার করেছে।
এই তিনজন শ্রমজীবী মানুষের ছবিটি শুধু একটি দৃশ্য নয়—এটি পাহাড়ি জীবনের গভীর গল্প। তারা শেখায়—পাহাড় যতই খাড়া হোক, পথ যতই কঠিন হোক, দৃঢ়তা আর পরিশ্রম থাকলে প্রতিটি সকালই নতুন সুযোগ নিয়ে আসে। এ গল্প পাহাড়ি মানুষের প্রাণশক্তি, সংস্কৃতি, সংগ্রাম এবং অদম্য আশাবাদের প্রতিচ্ছবি।


















