আগামী মঙ্গলবার রাঙামাটি আওয়ামী লীগের সম্মেলন। সর্বশেষ তথ্যমতে সম্মেলনে সভাপতি পদে লড়ছেন দলটির বর্তমান সভাপতি দীপংকর তালুকার আর সহ সভাপতি নিখিল কুমার চাকমা। সাধারণ সম্পাদক পদে লড়ছেন মুছা মাতব্বর ও কামাল উদ্দিন।
নিখিল প্রার্থীতা প্রত্যাহার না করায় ২৬ বছর পর ভোটে অংশ নিতে হচ্ছে তালুকদারকে। সর্বশেষ ১৯৯৬ সালের সম্মেলনের পর থেকে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় এককভাবে সভাপতি হয়ে আসছেন দীপংকর তালুকদার। সম্মেলনের শেষ মুহুর্তে বেশ জমে উঠেছে সম্মেলন।
হঠাৎ কেন পরিবর্তনের ডাক:
রাঙামাটি শহরের বাসিন্দা আওয়ামী লীগের সদস্য ও রাঙামাটি জেলা পরিষেদের গত পরিষদের এক সদস্য বলেন, দলটি আর আগের মত নেই তা সবাই ধরে নিতে পারেন। পরিবর্তনের ডাক যেহেতু এসেছে সেহেতু ভাবতে হবে।
দীর্ঘ বছরে অনেক ক্ষোভ জমেছে নেতাকর্মীদের মনে। তার বহি: প্রকাশ দেখা যাচ্ছে এ সম্মেলনে। জেলা কমিটি আজ দুই ভাগে বিভক্ত। এ কমিটির অধিকাংশ কাউন্সিলর নিখিলের পক্ষে কাজ করছে। এ নিয়ে স্বয়ং দীপংকর তালুকদার বিব্রত। শুধুমাত্র যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জেলা পরিষদের সুবিধা ভোগ করছেন এমন কাউন্সিলররা দীপংকরের পক্ষে কাজ করছেন।
দলের বিভাজন সৃষ্টি করেছে মুলত জেলা পরিষদ গঠন প্রক্রিয়া। দলে অনেক উচ্চ শিক্ষিত দল প্রতিষ্ঠান চালাতে সক্ষম এমন সদস্য আছে। কিন্তু তাদের কোথাও স্থান হচ্ছে না।
তিনি বলেন, একক সিদ্ধান্তে এত বড় দল চলতে পারে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে এত বছর ধরে দলটি চলেছে একক সিদ্ধান্তে। আর সে সিদ্ধান্ত গ্রহীতা ছিলেন দীপংকর তালুকদার।
দেখা গেছে জেলা পরিষদের কেউ কেউ তিনবার সদস্য হয়েছেন। অথচ অনেক নেতা আজ ভিক্ষা খুঁজেন এমন অবস্থা। এত বড় দল জেলা পরিষদ গঠনে কারোর মতামত নেন না দীপংকর। তিনি নিজের ইচ্ছেমত করে সদস্য বানান। এসব কারণে মুলত দলের ভিতর ক্ষোভ জমেছে। নির্বাচন না হলে কোন্দল ক্ষোভ আরো বাড়বে। নির্বাচন হলে নেতা কাউন্সিলরদের মধ্যে একটা উপলব্ধি আসবে। দলের একটি অংশের নেতাকর্মীরা মনে করেন, দীপংকর এবার ক্ষমতায় পেলে আরো বেপোরোয়া হতে পারে।
দলটির সূত্র জানায়,
সর্বশেষ পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডে যখন চেয়ারম্যান হবার যখন নিখিল যখন চেয়ারম্যান হবার জন্য তদবির শুরু করেন তখন দীপংকর তাকে কোন প্রকার সহযোগীতা করেননি। পক্ষান্তরে চেয়ারম্যান হবার পর নিখিলকে নানান ভাবে হয়রানী করেন দীপংকর। এমনকি দল থেকে বের করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করে। এ নিয়ে দীপংকরের উপর বেশ ক্ষুব্দ হয়েছেন নিখিল কুমার। এ থেকে তিনি নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন।
দলটির একটি সূত্র জানায়, গত ১৮ মে বিকালে রাঙামাটি জেলার ১০ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন রাঙামাটি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংসুইপ্রু চৌধুরী। সেখানে অংসুইপ্রু সবার মতামত নিয়ে সবাইকে দীপংকরকে এবার বিজয়ী করার অনুরোধ করেন। বৈঠকে অংসুইপ্রু বলেন, দীপংকর তালুকদার আর বেশী দিন রাজনীতি করতে পারবে না। বয়স হয়েছে। এবারে একটি বার সুযোগ দিলে আগামীবারে তিনি স্ব সম্মানে এ প্রক্রিয়া থেকে সরে দাঁড়াবেন। সেজন্য এ বৈঠকের পর একটি সমন্বয়কারী দল নিখিলের কুমারের কাছে যাবে। দলটি নিখিলকে সম্মেলনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা থেকে সরে দাঁড়াতে অনুরোধ জানাবে।
এদিকে দীপংকরের পক্ষে ভোট চেয়ে বেড়াচ্ছেন ছাত্রলীগ যুবলীগ মহিলা লীগের নেতাকর্মীরা। এ নিয়ে স্বয়ং বিব্রত কাউন্সিলররাও।
লংগদুর এক কাউন্সিলর বলেন, শনিবার রাঙামাটি ছাত্রলীগ যুবলীগ মহিলা লীগের একদল নেতাকর্মী আমাদের কাছে ভোট চাইতে আসে। এ নিয়ে আমরা বিব্রত। তিনি বলেন, দীপংকর তালুকদার আমাদের কাছে সিনিয়র বা কাউন্সিলর লোক পাঠাতে পারতেন। যেহেতু এটা আমাদের দলীয় আভ্যন্তরীণ বিষয়। জুনিয়রদের দিয়ে এসব কাজ করা হচ্ছে এ নিয়ে আমরা বিব্রত।
সূত্রটি জানায়, এ জুনিয়র দলটি ২১ মে সন্ধ্যায় নিখিলের কাছে যায়। নিখিলের কাছে গিয়ে নিখিলকে নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে দীপংকরকে পদ ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করে। এ সময় নিখিল তাদের বলেন, এটি দলের বিষয় তোমাদের এ নিয়ে মাথা ঘামাোর দরকার নেই।
নিখিল অনুসারী সূত্র যা বলছে:
নিখিল অনুসারী হিসেবে পরিচিত দলটির সাংগঠনিক সম্পাদক মো আব্দুল মতিন বলেন, ‘দীর্ঘদিন গণতন্ত্র চর্চার অভাবে দলে একটি একঘেয়েমি ভাব এসেছে। পরিবর্তন আনা দরকার’।
সূত্রটি আরো জানায়, দীপংকর গত নির্বাচনের আগেও বলেছিলেন এটি তার শেষ নির্বাচন। কিন্তু তার নির্বাচন শেষ হয় না। আগামীতে নির্বাচন করতে চায় সে। তিন বছর পর নির্বাচন হবার কথা থাকলেও দীপংকর নির্বাচন না দেওয়ার জন্য নানা তালবাহানা করে থাকেন। ৩ বছরের জায়গায় ১০ বছর পার হয়ে যায়। যেন তার পদ দীর্ঘ স্থায়ী হয়। তার বৃদ্ধ বয়স অপেক্ষা করতে করতে দলের অনেক নেতাকর্মী মারা যাবে। তবু দীপংকরের শেষ আশা পুরণ হবে না। তাই এবার নিখিল নির্বাচন থেকে কোনভাবে সরে যাবে না।
কাউন্সিলররা যা বলছেন:
জেলা আওয়ামী লীগের এবার সম্মেলনে কাউন্সিলর হয়েছেন ২৪৬ জন। এসব কাউন্সলিররা সব প্রার্থীকে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছেন। কাপ্তাই উপজেলার এক কাউন্সিলর বলেন, আমরা সব প্রার্থীকে বুঝতে দিচ্ছি না কাকে সমর্থন দিচ্ছি। যে প্রার্থী আসছে তার সাথে বসছি। ভোটের আশ্বাস দিচ্ছি। কারণ সব প্রার্থী হেভিওয়েট। সব প্রার্থীর জয়ের সম্ভাব্যনা ফিফটি ফিফটি। আপাতত কাউকে প্রকাশ্যে সমর্থন দিয়ে আমরা কারোর বিদ্বেষভাজন হতে চাচ্ছি না।
সম্মেলন হয়ে গেলে তাদের কাছে আমাদের যেতেই হবে। এখন জেলা কমিটি দু ভাগে বিভক্ত। এ বিভক্ত কমিটির দুই তৃতীয়াংশ নিখিলের পক্ষে প্রকাশ্যে কাজ করছে। যেটা দীপংকরের পক্ষে দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু উপজেলায় সে বিভু্ক্তি দেখা যাচ্ছে না।
প্রার্থীরা যা যা বলেছেন:
সম্মেলন বিষয়ে দীপংকর তালুকদার বলেন,
সম্মেলনে আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শেষ। ২৪ মে যেন ঝড় বৃষ্টি কাল বৈশাখী না হয় সে প্রার্থনা করে যাচ্ছি। নিখিলের প্রার্থীতা কিভাবে নিচ্ছেন জানতে চাইলে দীপংকর বলেন, আরো কে কে প্রার্থী হচ্ছে তা সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে জানা যাবে সম্মেলনে কে থাকছে কে থাকছে না। আমরা দেখি সম্মেলনে কোন কোন জেলায় ২২-২৩ জন প্রার্থী হয়। এভাবে যত প্রার্থীতা আসবে তত দল শক্তিশালী হয়। এটি খারাপ কিছু না।
নিখিল কুমার বলেন,
দলের নেতাকর্মী ও কাউন্সিলররা আমাকে সভাপতির পদে প্রস্তাব করেছেন। তাদের প্রতি সম্মান রেখে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত্ নিয়েছি। প্রার্থীতা প্রত্যাহারের আপাতত কোন চিন্তা নেই আমার। জয় নিয়ে আমি দৃঢ় আশাবাদী। কারণ আমার প্রতি নেতাকর্মীদের অগাধ বিশ্বাস আছে। কাউন্সিলররা আমার পাশে আছে।
আমি সভাপতি হলে দলের যে আদর্শ লক্ষ্য তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাব। আওয়ামীলীগ সরকারে যে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে তা অব্যাহত রাখতে কাজ করব। দল সুগঠিত করার লক্ষ্যে কেন্দ্র যেটা সিদ্ধান্ত নেবে আমি সেটা মেনে নিব।
কামাল উদ্দিন বলেন,
আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আমাকে কখনো নিখিল পন্থি বলে বেড়াচ্ছেন। কখনো জেএসএসের এজেন্ট বলে বেড়াচ্ছেন। এ দুটিই আসলে প্রোপাগান্ডা। নিখিল তার মত করে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। দীপংকর তার মত করে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। আমি কারোর সাথে প্যানেল করছি না। আমি কারোর পক্ষে চাচ্ছি না। আমি আমার পক্ষে ভোট চাচ্ছি। আমি এক সময় ৪ বছরের মত ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলাম। সে অভিজ্ঞতাগুলো কাউন্সিলরদের সাথে ভাগাভাগী করে ভোট চাচ্ছি। আমার কাছে অভিযোগ এসেছে মুছা টাকা উড়াচ্ছে।
মুছা মাতব্বর বলেন,
আমি দল থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। কাউন্সিলররা আমাকে সম্মান করেছেন। প্রধানমন্ত্রী, দীপংকর দার কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আমি আরো একবার সাধারণ সম্পাদক পদে সুযোগ চাচ্ছি। কাউন্সিলরদের কাছে যাচ্ছি। যথেষ্ট সাড়া পাচ্ছি। কেউ আমাকে নিরাশ করছে না। আমার এখন সময় এসেছে দলকে কিছু দেওয়ার। জয়ী হলে আমি দলকে আরো ভাল কিছু উপহার দিতে পারব।দলকে আরো গতিশীল করব।
দলটির সূত্র জানায়, ২০১২ সালে সম্মেলন হবার পর মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন হওয়ার কথা ২০১৯ সালের ২৫ নভেম্বর। কিন্তু সেদিন কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত থাকতে না পারায় তা স্থগিত রয়ে যায়। এরপর করোনার কারণে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়নি। পরে ২৪ মে সম্মেলনের দিন ঠিক করা হয়।
সম্মেলনে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রধান অতিথি থাকবেন। উদ্ধোধক হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা আওয়ামী লীগের প্রেসেডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি। বিশেষ অতিথি হিসাবে উপস্থিত থাকার কথা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল-আলম হানিফ, যুগ্ম সম্পাদক ড. হাসান মাহমুদ এমপির।
এ সংক্রান্ত আরো খবর