২৫০ শয্যার কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল এখন অনিয়ম, দুর্নীতি আর সিন্ডিকেট বাণিজ্যের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে। জনবল সংকটের অজুহাতে সরকারি বরাদ্দ লুটেপুটে খাচ্ছে একটি চক্র। খাবার মান, চিকিৎসা সেবা, ওষুধের সহজলভ্যতা-সবখানেই রোগী ও স্বজনদের অভিযোগের শেষ নেই।
প্রায় ২৯ লাখ স্থানীয়, ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা এবং লাখো পর্যটকের চিকিৎসার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হওয়ার কথা কক্সবাজার সদর হাসপাতাল। কিন্তু সেখানে এখন সেবা নয়, চলছে সিন্ডিকেটের রমরমা বাণিজ্য।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর হাসপাতালে তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব নেন ডা. মং টিংঞো। দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই স্বাস্থ্যসেবার মান পড়তে শুরু করে। পরিচ্ছন্নতা, চিকিৎসক উপস্থিতি থেকে শুরু করে অপারেশন, ভর্তি এবং ওষুধ সরবরাহ—প্রতিটি স্তরে ধরা পড়ে অনিয়মের চিত্র।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গত মে মাসে সরেজমিন পরিদর্শনে এসে হাসপাতালের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেন এবং ডা. মং টিং এর কার্যক্রম নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, তত্বাবধায়ক ডাঃ মং টিং এর সিন্ডিকেটের অন্যতম হলেন ঠিকাদার অভি ও তুষার কান্তি পাল। তুষার দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন। তার বিরুদ্ধে অনিয়মের অভিযোগ উঠায় গত ৪ মে তাকে রামু স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’এ বদলী করা হয়। রামু বদলী করা হলেও তাঁকে প্রায় প্রতিদিনই সদর হাসপাতালের প্রশাসনিক ভবনের বিভিন্ন কক্ষে দেখা যায়। তুষার কান্তি পালের বদলীর পর তার জায়গায় আসেন মোহাম্মদ ইসহাক নোমান। তিনি গত ৮ মে যোগদান করেন। নিয়মানুযায়ী তাঁকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার কথা, কিন্তু তুষার কান্তি যাওয়ার সময় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন হিসাবরক্ষক প্রবীর কুমার পালকে। প্রবীর কুমারও দশ বছরেরও বেশি সময় ধরে একই জায়গায় চাকরি করছেন।
হাসপাতালের ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব পালন করছেন এস্তাফিজুর রহমান। রোহিঙ্গাদের রান্না জন্য প্রতিমাসে শরনার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০ হাজার টাকা। তিনজন বাবুর্চীকে ৪ হাজার টাকা করে ১২ হাজার টাকা দিয়ে বাকি ৮ হাজার টাকা ভাগ করেন ক্যাশিয়ার এস্তাফিজুর ও স্টুয়ার্ড নোমান। এস্তাফিজুর বিরুদ্ধে হাসপাতালের সংস্কার কাজ করে ভুয়া বিল তৈরি করে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার দায়িত্বের বাইরে গিয়ে এই কাজ করতে হয়। এজন্য আমি ৪ হাজার টাকা নিই।’
‘আপনি তো সরকারি চাকরি করেন, সরকার আপনাকে বেতন দেয়’ এমন প্রশ্ন তোলা হলে তিনি বলেন, ‘ঠিক আছে আজ থেকে আমি এই কাজ করবো না।
স্টুয়ার্ড’র দায়িত্বে আছেন মো: নোমান। তার কাজ হচ্ছে, কিচেনের ডায়েট স্কেল অনুসারে রোগীদের খাবারের মালামাল বুঝিয়ে দেওয়া এবং ওয়ার্ডে ঠিকমতো খাবার পরিবেশন করা। কিন্তু, তিনি এসব কাজ ফাঁকি দিয়ে হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ সনদ (মেডিকেল সার্টিফিকেট) দেওয়ার কাজ করছেন। তার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক একটি কক্ষ দখল করে সার্টিফিকেট বাণিজ্য করে যাচ্ছেন বলে অভিযোগ পাওয়া যায়।
হিসাব রক্ষক প্রবীর কুমার পালের বিরুদ্ধে ভুয়া বিল তৈরি করে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। সিনিয়র স্টাফ নার্স রাহুল কান্তি দাশের কাজ হচ্ছে, প্রতিটি ওয়ার্ডে গিয়ে রোগীদের সেবা দেওয়া। কিন্তু, তিনি তার দায়িত্ব পালন না করে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে কাজ নিয়ে থাকেন। অফিস সহকারী (কাম কম্পিউটার) অজয় পাল তুষার কান্তি পাল ও প্রবীর কুমার পালের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। সহকারী হিসাব রক্ষক হিসেবে আমিনুল হক আনোয়ারের চাকরি করার কথা থাকলেও তাঁকে দেওয়া হয়েছে প্যাথলজী বিভাগে। এদিকে তুষার কান্তি পালের জায়গায় আসেন সহকারী কাম হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ ইসহাক নোমান। তিনি গত ৮ মে যোগদান করেন। কিন্তু দুই মাস পার হলেও এখনো তাকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়নি তার দায়িত্ব। তুষার কান্তি যাওয়ার সময় দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়া হয় তার দূর্নীতির অন্যতম সহযোগি ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হিসাব রক্ষক প্রবীর কুমার পালকে। প্রবীর কুমার দীর্ঘ একযুগ ধরে একই জায়গায় চাকরি করছেন। এদিকে তুষার পাল বদলী হওয়ার দুই মাসের ব্যবধানে আবারও সদর হাসপাতালে আসার জন্য তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানা যায়।
এবিষয়ে জানতে চাইলে জেলা সিভিল সার্জন ডা: মাহমুদুল হক বলেন, ‘তুষার কান্তি আমার কাছে এসেছিলেন ফরওয়ার্ডিংর জন্য, দিলাম। যেকেউ আমার কাছে ফরওয়ার্ডিংর জন্য আসলে আমি দিতে বাধ্য। কেউ যদি কক্সবাজার থেকে গোপালগঞ্জ যেতে চায় যেতে পারবে৷ কোনো সমস্যা নেই।
আউটসোর্সিং প্রকল্পে ৬৪ জন স্টাফের মধ্যে কর্মরত আছেন ৫৯ জন। এদের একেক জনের বেতন ১৬ হাজার ১৩০ টাকা। সেই হিসেবে সরকারিভাবে এসব স্টাফদের জন্য বরাদ্দ আসে প্রতিমাসে ১০ লক্ষ ৩২ হাজার ৩২০ টাকা। কিন্তু তাঁদের দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা করে। অবশিষ্ট ৩ লক্ষ ৬১ হাজার ৬৭০ টাকা ও পাঁচ জনের টাকাসহ প্রতিমাসে ৪ লক্ষ ৪২ হাজার টাকা কেটে নেওয়া হয়। বেতনের টাকা সংশ্লিষ্ট কর্মচারীর ব্যাংক হিসেবে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও হাতে হাতে দেওয়া হয় তাঁদের বেতন।
নাম জানাতে অনিশ্চুক একজন স্টাফ বলেন, ‘আমার বেতন ১৬১৩০ টাকা পাওয়ার কথা, কিন্তু আমাকে দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা। ঠিকাদার অভি ও তুষার স্যার এসব টাকা খেয়ে ফেলেন। একবার বেতনের বিষয় নিয়ে জানতে চাওয়াতে চাকরি খেয়ে ফেলার ভয় দেখান।
এসব টাকা যাচ্ছে কার পকেটে এমন তথ্য খুঁজতে গিয়ে নাম আসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অভি এন্টারপ্রাইজের। প্রতি অর্থবছরে ভর্তি রোগিদের খাবার ও স্টেশনারি সরবরাহের টেন্ডার আহবানের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় অখ্যাত সব পত্রিকায়। অন্যের ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে কাজ পায় অভি এন্টারপ্রাইজের মালিক অভি। তিনি প্রতিবার ঘুষের মাধ্যমে কাজ পেয়ে যান বলে জানা যায়। তার সাথে যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। হোয়াটসঅ্যাপে ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়েও তার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
শিমুল কান্তি দে, বর্তমানে ওয়ার্ড বয় হিসেবে আউটসোর্সিংয়ে (আইওএম, আরআরআরসি প্রজেক্ট) চাকরি করছেন। তার কোন নিয়োগ নেই। তুষার কান্তি পালের আত্মীয় হওয়ায় তাকে ওয়ার্ড বয় থেকে ওয়ার্ড মাস্টারের দায়িত্বে বসানো হয়। শুধু নিয়োগ বাণিজ্য নয়, প্রতিটি বিভাগে স্বজনপ্রীতির কারণে ডুবতে বসেছে ২৫০ শয্যার এই হাসপাতাল।
চলতি বছরের মে মাসে সদর হাসপাতালের অনিয়ম বন্ধে হাসপাতালের মূল ফটকে মানববন্ধন ও কর্মসূচী পালন করেন ভয়েস অব কক্সবাজার ভোলান্টিয়ার্স নামের একটি প্লাটফর্ম। কর্মসূচী থেকে বলা হয়েছে, সরকারি এ সেবা প্রতিষ্ঠানটি নানা সমস্যায় জর্জরিত। অনিয়মের বেড়াজাল আর দুর্নীতি বাণিজ্যের যেন শেষ নেই। সিন্ডিকেট করে হাসপাতালের সেবার নামে লুটেপুটে খাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। জনবল থেকে শুরু করে চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং ভর্তি হওয়া রোগী ও চিকিৎসা নিতে আসা সাধারণ মানুষের সমস্যা লেগেই রয়েছে।
বিষয়গুলো অকপটে স্বীকার করলেন সদর হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডাঃ মং টিংঞো। গত রোববার দুপুরে তার কার্যালয়ে দেখা করতে যায় এই প্রতিবেদক। হাসপাতালের অনিয়মের বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ দেখেন উপরে একদম মন্ত্রনালয় থেকে শুরু করে নিচে পর্যন্ত টাকা দিতে হয়। কক্সবাজার সদর হাসপাতাল বরং অনেক ভালো আছে, ১০ হাজার টাকা বেতন পাওয়া অনেক ভাগ্যের। চট্টগ্রাম মেডিকেলে স্টাফদের বেতন ৭-৮ হাজার টাকা। তাই বলে সরকারি টাকা কেটে নেওয়ার কোন নিয়ম আছে কি? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এই প্রশ্ন আমাকে করছেন কেন? আপনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে করেন। তবে রোহিঙ্গাদের খাবারের জন্য আসা বরাদ্দ টাকা নিয়ে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান।
এসময় তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ক্যাশিয়ার এস্তাফিজুরকে ডাকেন এবং বিষয়টি নিয়ে জানতে চান। তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের খাবার রান্নার জন্য আরআরআরসি অফিস থেকে টাকা আসে তাতো জানতাম না! আমি আরেকটু খবর নিয়ে দেখছি।