৪ মাস আগেও যার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, হাসপাতালের বারান্দা কিংবা ফুটপাথে, কিংবা কোনো দোকানের সামনে তাঁর রাতদিন কাটতো। সে অন্ধ লক্ষীরাণীর কথা বলছি। যার প্রতি মূহুর্ত কাটতো তার নিদারুণ কষ্টে। সেই লক্ষী রানীর জীবনে এখন বইছে সুখের বসন্তবাতাস। হয়েছে মাথা গোঁজার স্থায়ী ঠাঁই। রোদে পুড়তে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজতে হচ্ছে না অন্ধ লক্ষী রানীকে।
চলতি বছরের ১ জুন কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান উপজেলার ১ নং চন্দ্রঘোনা ইউনিয়ন এর ৯ নং ওয়ার্ডের মিশন খিয়াং পাড়ায় অন্ধ লক্ষী রানী দে ‘ কে উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে তৈরিকৃত নতুন ঘরে তুলে দেন। সেদিন তিনি লক্ষীর জন্য নতুন কাপড়,খাবারদাবার,ঘরের সরঞ্জামাদিসহ নিয়ে যান। ইউএনও মুনতাসির জাহান সেই ঘরের নাম রাখেন ” লক্ষীনিবাস”।
সোমবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দুপুরে এই প্রতিবেদক যান “লক্ষীনিবাসে”। সেই সময় অন্ধ লক্ষী রানী দে দুপুরে খাবার খাচ্ছিলেন। কেমন আছেন জানতে চাইলে, এই প্রতিবেদককে একরাশ হাসি মুখে তিনি চট্টগ্রামের ভাষায় বলেন, ওবা আইঁ বহুত ভালা আছি, সুখত আছি, ইউএনও ম্যাডাম,আঁর মা,আঁরে এক্কান সুন্দর ঘর বানায় দিয়ে( আমি অনেক ভালো আছি, সুখে আছি, ইউএনও, কাপ্তাই যিনি আমার মা, আমাকে একটা সুন্দর ঘর তৈরী করে দিয়েছে)। অন্ধ লক্ষী রানী দে, ইউএনওর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান।
মিশন এলাকার বাসিন্দা মংচিং মারমা জানান, আমি প্রতিদিন ঘর হতে বের হলে একবার হলেও তার ঘরে যাই। তাকে খাবার দিই, মিশন এলাকার অনেকেই লক্ষী রানী দে কে খাবার দেন। আমার আনন্দ লাগে তার সুখ দেখে।এই ক’মাসে লক্ষীরাণীর চেহারা ই বদলে গেছে।
৯ নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য জুয়েল চাকমা এবং মিশন এলাকার বাসিন্দা সংস্কৃতিকর্মী অভিজিৎ দাশ কিষান জানান, সত্যিই লক্ষী রানীর সুখ দেখে আমরা আনন্দে আপ্লুত হই। তাঁরা সকলেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে ধন্যবাদ জানান।
প্রসঙ্গতঃ সত্তরোর্ধ্ব স্বামী সন্তান হারা অন্ধ লক্ষী রানী দে। রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলার চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল এর বারান্দায় গত ১৫ বছর ধরে তিনি বসবাস করে আসছেন। হাসপাতালের বারান্দা ছাড়াও মিশন হাসপাতাল গেইট এবং চন্দ্রঘোনা দোভাষী বাজারে দিনরাত কাটে তার । কি শীত, কি গ্রীষ্ম, কি বর্ষা কিংবা উৎসব পার্বন কখন যে চলে যায় তার জীবনে এই সবের কোন কিছু আসে যায় না। প্রতিদিন একবেলা আহার পেলেই চলে যায় তার দিবারাত্রি । জীবনের সুখের বসন্ত কি, লক্ষী রানী দে’ র গত ৩০ বছরেও একবার আসেনি।
রাঙামাটির রাজবাড়ি এলাকায় তার বাবার বাড়ী। তার বাবার নাম ক্ষিতিশ বিশ্বাস। কাপ্তাই বাঁধ হওয়ার ফলে তাদের পৈত্রিক বাড়ী কাপ্তাই লেকে তলিয়ে যাবার পর স্বাধীনতার আগে তারা স্ব- পরিবারে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার চন্দ্রঘোনা হিন্দু পাড়ায় মামার বাড়ীতে চলে আসেন। সেখান থেকে তার বিয়ে হয় রাউজান উপজেলার উনসত্তর পাড়া গ্রামের মানিক চন্দ্র দে’এর সাথে। সুখেই চলছিল তাদের জীবন। স্বামী কৃষি কাজ করে সংসার চালাতো। এরই মধ্যে তার ২ সন্তান পৃথিবীতে ভুমিষ্ট হয়। কিন্ত সবার কপালে কি সুখ আর সয়। তার প্রথম সন্তান লিটু দে মাত্র ১৩ বছর বয়সে দূরারোগ্য ব্যধিতে মারা যান পাহাড়তলি শ্বশুর বাড়ীতে। তার বড় ছেলে লিটু মারা যাবার পর ৬ বছর পর আর এক ছেলে সুজয় দে মাত্র ১১ বছর বয়সে সেখানে মারা যান। ছেলে হারা লক্ষী রানীর জীবন যেন এক বিভীষিকায় পরিনত হয়।
কথায় আছে “মরার উপর খাড়ার ঘাঁ”। ছেলে হারানোর ৮ বছর পর পুত্রশোক সইতে না পেরে লক্ষী রানী দে’এর স্বামী মানিক চন্দ্র দে সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে যান। স্বামী মারা যাবার পর তার জীবনে নেমে এসে আরোও চরম দূর্বিসহময় দিন। শশুড় বাড়ীর লোকজনের অত্যাচারে তিনি এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে চন্দ্রঘোনা হিন্দুপাড়া মায়ের ঘরে চলে আসেন। সেখানেও তার সুখ পাখি যেনো অধরা হয়ে রইল। সহায় সম্বল যা ছিল তা নিয়ে তার এক ভাই চলে যান অন্যত্র।
এরপর তিনি চন্দ্রঘোনা খ্রীস্টিয়ান হাসপাতাল এর চিকিৎসক ডা: মনোজ বড়ুয়ার বাসায় কাজ নেন। ডা: মনোজ বড়ুয়া ছাড়াও মিশন এলাকার অনেকের বাসাবাড়ীতে ঝি এর কাজ করে কোন রকমে তার জীবন চলতো।
এরই মধ্যে তার জীবনে আসে আরো একটি দু:স্বপ্ন। ১৯৯২ সালে চোখে দেখা দেয় তার কঠিন রোগ। অপারেশন করতে গিয়ে তিনি হারান তার দু’চোখ। চোখ হারানোর পর অনেকের বাসায় তার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এখন মানুষের দেওয়া অন্ন বস্ত্রে তার জীবন চলে। যেদিন পায় সেদিন খায়, না পেলে কখনোও কখনোও পানি খেয়ে হাসপাতাল এর বারান্দায় ঘুমিয়ে যান লক্ষী রানী দে।
বিভিন্ন সময় পত্র পত্রিকায় লক্ষী রানী দে’ কে নিয়ে বিভিন্ন হৃদয়বিদারক সংবাদ প্রচারিত হয়। এই সব সংবাদ নজরে আসার পর এগিয়ে আসেন কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ( ইউএনও) মুনতাসির জাহান। তিনি বেশ কয়েকবার মিশন হাসপাতাল গেইট এলাকায় এসে লক্ষী রানীর খোঁজ খবর নেন এবং তাঁকে আর্থিক সহায়তা করেন। সেইসময় ইউএনও মুনতাসির জাহান তাঁকে ঘর করে দেবার প্রতিশ্রুতি দেন। যেহেতু লক্ষী এই এলাকার বাইরেও যাবেননা আবার এখানে কোনো খাসজমি ও নেই,তাই ইউএনও এর এই উদ্যোগে এগিয়ে আসেন চন্দ্রঘোনা মিশন হাসপাতাল এলাকার বাসিন্দা মংচিং মারমা। তিনি এক গন্ডা জায়গা দেন লক্ষী রানী দে কে ঘর করে দেবার জন্য। সেই জায়গার উপর কাপ্তাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মুনতাসির জাহান স্থানীয় উদ্যোগে ঘর নির্মাণের কাজ শুরু করেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন ভরাবর্ষার আগেই লক্ষী ঘরে উঠবে। কথা রেখেছেনও তিনি। আজ সে লক্ষীনিবাসে লক্ষী সুখে দিনযাপন করছে।
ভালো থাকুক লক্ষীরাণীরা…