সাফ গেমসে দীর্ঘদিন পর বিরল জয়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গন এখন খুশীতে উন্মাতাল। দেশে যখন নারীর চলন-বলন-ধরন-পরিচ্ছদ নিয়ে একটা বৈরি সময়; ঠিক সে সময়ে এই বিজয় নারীর অগ্রযাত্রার পথে যেনো এক নবতরো সংযোজন। এই জয়ের সাথে খাগড়াছড়ি জেলা সদরের আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনী এবং লক্ষ্মীছড়ি উপজেলার মনিকা চাকমা’র নামও জড়িয়ে আছে কৃতিত্বের মোড়কে। পাহাড় এখন তাঁদের ছবিতে ছবিতে সয়লাব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম।
সাথে একসময়ের জাতীয় নারী ফুটবল দলের সদস্য এবং বর্তমানে সাফ বিজয়ী দলের সহকারি কোচ তৃষ্ণা চাকমা’র জন্যও শুভ কামনা অব্যহত রেখেছেন অসংখ্য অনুরাগী।
কিন্তু যেই যমজ বোনের কৃতিত্বে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে, সেই দুই বোন খাগড়াছড়ি জেলা সদরের সাতভাইয়াপাড়ায় আনাই মগিনী ও আনুচিং মগিনীদের বাড়ি। ভৌগলিকভাবে শহরতলীতে হলেও তাঁদের গ্রামটি একেবারেই দুর্গম। পিচঢালা পথ যেতে যেতে ইটের রাস্তা পেরিয়ে সরু-কদমাক্ত পথ মাড়িয়ে ঝুঁকিপূর্ণ এক সাঁকো পেরোলেই রিপ্রুচাই মগ আর আপ্রুমা মগিনীর বাসগৃহ। ওরা দুইজন হলেন, যমজ ফুটবল কন্যা আনাই-আনুচিং’র মা-বাবা।
মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, ঢোকার মুখেই বাড়ির দেয়ালে আঁকা চারটি ফুটবল শোভা পাচ্ছে বাহারি রঙে। দেখেই বোঝা যায়, এই বাড়ি যেনো অন্য এক ফুটবল বাড়ি। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে এগিয়ে এলেন আনাই-আনুচিংয়ের মা-বাবা, ভাই, বৌদি এবং ভাতিজি ভাতিজারাও।
ছোট বৌদি উম্রা মারমা বলেন, ওরা ফুটবল খেলে খ্যাতি পেয়েছে বলে আমরা এখন অনেক ভালো আছি। তাদের কারণে বাড়িতে বিদ্যুৎ এসেছে। পানির ব্যস্থা হয়েছে।
আরেক বৌদি আরুই মগিনী বলেন, টেলিভিশনে খেলা দেখি আর নাই দেখি; কিন্তু সকাল সকাল যখন দলে দলে সাংবাদিক আসতে থাকেন তখন পাড়া-প্রতিবেশী সবাই বুঝে যায় যে, আনাই-আনুচিং আরেকটা সুফল নিয়ে এসেছে।
আনাই-আনুচিংয়ের চার ভাতিজি চিংম্রাউ (৯), ম্রাবাই (৮), উক্রাই (৭) এবং উক্রাইঞো (৮)। এরা প্রত্যেকে বয়স অনুসারে স্কুলে পড়ছে। কিন্তু বাড়ি থেকে স্কুলের পথে পা ফেলতেই গভীর এক খাল পাড় হতে হয় বাঁশের নড়বড়ে সাঁকোতে।
এই শিশুদের মা আরুই ও উম্রা মগ জানান, পুরো বর্ষাকাল জুড়েই ভয়ে থাকি। ১০/১৫ ফুট গভীর খালটিতে পড়ে গেলে মৃত্যু ছাড়া যেনো আর রক্ষে নেই। কতো নেতা-চেয়ারম্যান এসে কথা দিয়ে গেছেন। কিন্তু সাঁকোর পরিবর্তন হয়নি।
আনাই-আনুচিংয়ের দুই বড়ো ভাই মংক্রচাই মগ পেশায় রাজমিস্ত্রী। তিনি জানালেন, বোনদের গর্বে তাঁরা সব সময় আনন্দে থাকেন। মা-বাবারা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন। কিন্তু তাদের বাড়ির প্রবেশ পথের রাস্তাটি যেমন খারাপ তেমনি খারাপ বাড়ির পাশের ছড়ার পানি পরিস্থিতিও। বর্ষাকালে দশ/পনের ফুট গভীর এই ছড়াটির ওপর একটি বাঁশের সাঁকো দিয়ে চলাফেরা করতে হয়।
তাঁদের সাথে সুর মিলিয়ে আনাই-আনুচিংয়ের মা-বাবা আপ্রুমা মগিনী ও রিপ্রুচাই মগ বলেন, আমাদের দুই মেয়ে আজ দেশের গর্বে পরিণত হয়েছে। জেলা প্রশাসক আমাদের জন্য অনেক কিছু করেছেন।
তাঁরা আক্ষেপ প্রকাশ করে বলেন, আমাদের বাড়িসংলগ্ন খালের ওপর সাঁকোটি ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় সেতু নির্মাণের কথা দিয়েছিলেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কিন্তু কখন হবে আমরা জানি না।
আনাই-আনুচিংদের বাড়ি থেকে ফেরার পথে সাতভাইয়াপাড়ার রাস্তার মুখে কয়েকটা দোকানপাট। ছোটখাটো বাজারের মতোই। আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি জটলা। ভরদুপুরেও জটলার কারণ জানতে চাইলে অজয় ত্রিপুরা বলেন, আমাদের গ্রামের মেয়ে ফুটবলে ভালো করছে বলেই নামীদামী লোকজন পাড়ায় আসছে। ডিসি-এসপি সবাই এখন আমাদের গ্রামকে চেনে। কিন্তু যাদের জন্য এই পাড়ায় াাসেন তাঁদের বাড়ি যাওয়ার যেনো কোন পথই নেই।
খাগড়াছড়ি জেলা ক্রীড়া সংস্থা’র সা. সম্পাদক জুয়েল চাকমা জানান, খেলোয়ারি কৃতিত্বের জন্য জেলা প্রশাসন নজিরবিহীন সহযোগিতা করেছেন। বিশেষ করে জেলা প্রশাক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস নারীদের ক্রীড়া উন্নয়নে খাগড়াছড়িকে দৃশ্যমান অগ্রগতির পথে নিয়ে গেছেন।
তিনিও ‘আনাই-আনুচিং’দের বাড়ি সংলগ্ন সেতুটি দ্রুত নির্মাণ হওয়া জরুরী বলে মত দেন।
জেলা প্রশাসক প্রতাপ চন্দ্র বিশ্বাস জানান, আনাই-আনুচিং মগিনী এবং লক্ষ্মীছড়ির মনিকা চাকমা’র বাড়ি সরেজমিন পরিদর্শন করেছি। তাদের মা-বাবা স্বজন এ্ং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলে তাদের সমস্যা জেনেছি। সেই মতে সরকারি অর্থায়নে জেলা প্রশাসন প্রতিশ্রুত মনিকা চাকমা’র বাড়ি নির্মাণ ও বিদ্যুতায়ন, আনাই-আনুচিংদের বাড়িতে গভীর নলকূপ, বিদ্যুতায়ন করা হয়েছে। আগেই তাদের তিনজনকে দুই লক্ষ টাকা করে সঞ্চয়পত্র করে দেয়া হয়েছে। এবার আরো এক লক্ষ টাকা করে দেয়া হবে। সহকারি কোচ তৃষ্ণা চাকমাকেও এক লক্ষ টাকা দেয়া হবে।
তিনি ‘আনাই-আনুচিং’দের বাড়ি যাবার পথে ঝুঁকিপূর্ণ সাঁকোর পরিবর্তে সেতু নির্মাণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড ও পার্বত্য জেলা পরিষদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।