বীনা ত্রিপুরা তখন ক্লাস এইটে পড়েন। হেসে খেলে বেড়ান এদিক ওদিক। সেই অল্প বয়সেই মা-বাবার ইচ্ছেতে বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে হয় তাকে।
খাগড়াছড়ি শহরের খাগড়াপুরের এই মেয়েটি নব্বই দশকের মাঝামাঝি সময়ে নৃত্যাঙ্গনের কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিল।
সে সময়ের কৃতি নাট্যশিক্ষক সুচরিতা রোয়াজার হাত ধরে ১৯৯৫ সালে নৃত্যশিল্পী হিসেবে পারফর্মেন্স করেছেন অনেক জাতীয় কর্মসূচিতেও।
বীনা আবেগী গলায় বলেন, ত্রিপুরা জাতিগোষ্ঠির অত্যন্ত জনপ্রিয় গান ‘ইসুক মাচাকমা, ত্রিপুরা জুংমা’ এই গানটির সাথে দারুণ নাচতেন।
তারপরেই বললেন, ১৮ বছর পর সংসার আলাদা হয়ে গেলো যখন বড় ছেলের বয়স ষোল, আর মেয়ের পড়তো ক্লাস ফোরে। দুটো ছেলে-মেয়ের জন্মের পর থেকেই সংসারে নেমে আসে অশান্তি। অনেকটা বাধ্য হয়েই ২০১৫ সালে স্বামীকে ডিভোর্স দিয়ে একা বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করেন।
ডিভোর্সের পর আটমাস কাজ করেছেন একটি টেইলারিং হাউজে। ২০১৫ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তরের ছয়মাস মেয়াদী প্রশিক্ষণ নেন। মৎস্য-পশুও পাখি পালন ট্রেডেও অংশ নেন তিনি।
যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে ঋণ হিসেবে ৫০ হাজার টাকা আর প্রতিবেশী চন্দনা ত্রিপুরা ২০ হাজার টাকা দিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
পরের দোকানে বীনার হাড়খাটুনি পরিশ্রম আর সামাজিক দুর্দশা দেখে চন্দনা ত্রিপুরা নিজের গলার হার বিক্রি করেই বীনাকে সাহায্য করেন।
যুব উন্নয়ন প্রশিক্ষণ শেষ করেই খাগড়াপুরের একটি ভাড়া বাসায় ‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’ দিয়ে নতুন করে সংগ্রাম শুরু করেন তিনি। সামনে দোকান আর পেছনে ছেলে-মেয়ে-সহকর্মীদের নিয়েই বীনা’র ঘর ও সওদাপাতি।
২০১৬ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২০ জন নারী তাঁর প্রতিষ্ঠান থেকে কাজ শিখে পরিবারের অবদান রাখছেন। শিক্ষাজীবন থেকে ঝড়ে পড়া, দরিদ্র, স্বামী পরিত্যাক্তা; এমন অসহায় নারীরাই ভীড় করেন বীনা’র কেন্দ্রে।
একা লড়াইয়ের পথ বেছে নিয়ে বীনা এখন স্বাবলম্বী নারী। যুব উন্নয়নের স্বল্প মেয়াদের প্রশিক্ষণে নিজেকে গড়ে তোলেন অন্য এক অভিজ্ঞতায়। সুঁই-সুতার গাঁথুনিতে পারঙ্গম বীনা সব বাধা-বিপত্তি ডিঙিয়ে ছিনিয়ে এনেছেন ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে অর্জন করেন, ‘জাতীয় যুবপদক’।
বীনা বলেন, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের কারণেই সংসার ভেঙ্গে যায়। বিয়ের সময়কার প্রিয় জিনিস, যাবতীয় সামগ্রী, মেয়ের পড়ার টুল-টেবিল কিছুই আনতে পারেননি। মেয়ে হেমী ত্রিপুরা এখন দেশসেরা কলেজ ‘হলিক্রস’-এ পড়ছে। হেমী ২০১৬ সালে ক্লাস ফাইভে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছে।
পার্বত্য জেলা পরিষদ থেকেও কৃতিত্বের সাথে বৃত্তি পেয়েছে। ছেলে অর্কিড ত্রিপুরা এখন ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স শেষ করে এখন চাকরির অপেক্ষায়।
খাগড়াছড়ি সদরের তৈবাকলাই-গাছবানের মতো গ্রাম থেক অনেক নারী আসেন। এছাড়াও দূরের সাজেক-দুর্গম তৈচুই থেকে এসে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন কিশোরী-ছাত্রীরা।
এখন বীনা ত্রিপুরা’র ‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’-এবং শহরের মহাজনপাড়ার আরো একটি সেলস সেন্টার মিলে পুঁজি এখন বিশ লাখ টাকার চেয়েও বেশি। গড়ে প্রতিমাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় হচ্ছে।
কথা হয় জেলাসদরের ইসলামপুরের মুন্নী আকতার ও পুতুল, কুমিল্লা টিলার জয়নব আকতার, নাসরিন আকতারের সাথে। যাঁরা ‘হেমী টেইলার্স এন্ড চেট্রনিং সেন্টার’ থেকে কাজ শিখেই হাঁটছেন আয়ের পথে। নিজের ঘরে সেলাই ছাড়াও অর্ডার পাচ্ছেন পাড়া-প্রতিবেশীরও।
বীনা’র বাসায় থেকে একই সাথে সেলাই এবং সরকারি মহিলা কলেজে পড়ছেন সরেন্দ্রী ত্রিপুরা। একই সাথে লেখাপড়া আর কাজ শিখছেন জলিতি ত্রিপুরা।
ছয়মাস বিনামূল্যে কাজ শেখার পর শেষে একবছর বেতনের বিনিময়ে তাঁর সেন্টারে কাজ করার এই সহজ শর্তেই এগিয়ে যাচ্ছে ‘হেমী টেইলার্স এন্ড ট্রেনিং সেন্টার’।
এখন জেলা নয় সারাদেশের পরিচিত এক প্রতিষ্ঠানের উদ্যেক্তা বীনা ত্রিপুরা।
বীনা বলেন, একাকী জীবনে আসার পর থেকেই সমাজের ভালো-মন্দ সব মানুষের মুখেই নেতিবাচক আলোচনা-সমালোচনা শুনতে শুনতে এগোচ্ছি। নারীদের জন্য প্রকৃত অর্থেই এ সমাজ বৈরী। শুরুর দিকে স্থানীয় গীর্জা থেকে একটি সেলাই মেশিন দেয়া হয়েছিল। এখন নিজেকে নিয়ে অনেক স্বস্তিতে চলি। ভালো আছি নিজে এবং অন্য অনেক নারীকে আলো’র পথে আনার চেষ্টা করে যাচ্ছি।
নিজের স্বপ্ন বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সমাজের বঞ্চিত নারীদের সেলাই শেখানোর জন্য দুয়ার খোলা রেখেছি। এখনও প্রতিদিন সাতজন বিভিন্ন বয়সী নারী প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। আবার কেউ কেউ কাজ শেখার পর নিজেরাও বাসাবাড়িতে বাণিজ্যিকভাবে আয় করছে।
তাঁর মতো বিপদগ্রস্তদের প্রতি একটিই আহ্বান, সব নারী যেন ঘর সংসারের পাশাপাশি নিজের কর্মদক্ষতাকে শাণিত রাখেন। স্বামী অথবা অন্যদের ওপর নির্ভরতার বাইরে কিছু একটা করার প্রত্যয় রাখেন। তাহলে সমাজে নারী-পুরুষের অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং মর্যাদার ভারসাম্য টিকে থাকবে।
আমাদের সমাজে সংসারে বা যৌথ পরিবারের সব পুরুষই আসলে প্রথাগতভাবে পুরুষতান্ত্রিক। কোন কোন ক্ষেত্রে এমনকি নারীরাও। এই যেমন আমি নির্যাতিত হতে হতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে গেলাম। জীবন বিষিয়ে উঠেছিল। জীবনের প্রতি হয়ে পড়ি বীতশ্রদ্ধ। অথচ নিকটাত্মীয় নারীরাও খুব বেশি আমার পাশে দাঁড়াননি। সব দোষ ঘাড়ে নিয়ে সমাজের নানা বঞ্চনা মাথায় নিয়ে আজকের বীনা হয়ে উঠেছি।
২০১২ সালে পিত্তথলির অপসারণ করার পর থেকেও সংসার ভেঙ্গে যাবার উপক্রম হযেছিল। শরীরে এখনও বহন করছি সাংসারিক জীবনের শারীরক নির্যাতনের অনেক চিহ্ন।
তবু বলবো, বুকে সাহস-সততা-শক্তি এবং দক্ষতা প্রমাণ করতে পারলে কারো দিন কারো জন্য আটকে থাকে না। শেষবারও যদি বলি, ‘যে জীবন একা, সে জীবন লড়াইয়ের’।