ফণী যে’য়ে দংশিয়াছে মম শিরোমণি। ফিরিয়া করহ কৃপা আস্তিক জননী। ফাঁপর হয়েছি মাত শুন বিষহরী। ফণিরূপা ফির তুমি হংসপৃষ্ঠে চড়ি। বাপে সমর্পিল মোরে লক্ষ্মীন্দর করে।’ – ৬০ বছর বয়সী রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলার রাইখালী বাজারের বাসিন্দা মীনা দে রাইখালী ঐতিহ্যবাহী ত্রিপুরা সুন্দরী কালি মন্দিরে এভাবেই সুর করে পুঁথি পাঠ করছেন। অন্য নারীরা সমবেত কণ্ঠে ঘোষা দিচ্ছিলেন। সাথে জোড়খাই, করতাল, হারমোনিয়াম সহ নানা যন্ত্র সঙ্গতে যেন একটি অপূর্ব সুরধ্বনি সৃষ্টি হচ্ছিল।
কথা হয় মীনা দে এর সাথে। তিনি বলেন, গত ৪০ বছর ধরে মনসা পুঁথি সহ জাগরন পুঁথি ( দূর্গা পুজা সময় পড়া হয় এটা) পাঠ করে আসছি। আশেপাশের মাইকের আওয়াজ যতদূর যেতো শত শত লোক মন্দিরে এসে মনসা পুঁথি শ্রবন করতো। কিন্ত বর্তমানে কমে এসেছে পুঁথি পাঠ। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা আর পুঁথি পাঠে আগ্রহী হচ্ছে না।
শ্রাবন মাসের ১ তারিখ হতে পুরো মাস জুড়ে একসময় গ্রামের পাড়ায় পাড়ায় পুঁথি পাঠ হতো। কখনো কারে গৃহে আবার কখনোও কোন মন্দিরে রাতভর মনসা পুঁথির আসর বসতো। হিন্দুদের দেবী মনসাকে সন্তুষ্টি এবং সর্প দংশন হতে মুক্তি কামনায় হিন্দু ধর্মালম্বীরা এই পুঁথি পাঠ করতো।
মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা। মনসা মূলগতভাবে অনার্য দেবী। ভারতের আদিবাসী ও অন্ত্যজ সমাজে সর্পদেবী মনসার পূজা সুপ্রচলিত। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, খ্রিষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে বাংলায় মনসার পূজা প্রবর্তিত হয়। এই মনসা পুজাকে কেন্দ্র করে এই পুঁথি পাঠের আসর। আগামী ১৭ আগস্ট মনসা পূজা। এদিন ছাগল বলির রেওয়াজ আছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলে মনসা পুজার দিন পুজার পাশাপাশি হিন্দু সম্প্রদায় পাঁঠা ছাগল বলি দেয়।
রাঙামাটির কাপ্তাইয়ের বিভিন্ন মন্দির এবং সনাতন পল্লীতে গিয়ে মনসা পুঁথির পাঠ নিয়ে অনেক তথ্য পাওয়া যায়। তাদের একজন কেপিএম কয়লার ডিপু এলাকার ৬০ বছর বয়সী সংগীত শিল্পী খোকন মল্লিক এবং ৫৬ বছর বয়সী রণধীর চক্রবর্তী। তাঁরা জানান, সেই স্কুল জীবন হতে আমরা পুঁথি পাঠে অংশ নিতাম। প্রথমে বিভিন্ন জন পাঠকের সাথে দোহার হিসাবে কাজ করতাম। এরপর ধীরে ধীরে মনসা পুঁথির বিভিন্ন ঘোষা, লাচার, পয়ার আমরা আত্মস্থ করি। গত ৩০ বছর ধরে আমরা পুঁথি পাঠ করে আসছি। কিন্ত বর্তমানে বয়সের কারনে কন্ঠে সুর আর ধরে না।একসময় আমাদের কেপিএম হরিমন্দির এর কীর্তনের দল মাস ব্যাপী ঘরে ঘরে, মন্দিরে মন্দিরে গিয়ে পুঁথি করতো। বর্তমানে মাঝে মাঝে পুঁথি পাঠের আসর বসলেও আগের তুলনায় কমে এসেছে পুঁথি পাঠের আসর।
কথা হয় কাপ্তাইয়ের কয়লার ডিপুর বেলা রানী মল্লিক, চন্দ্রঘোনা মিশন এলাকার মিতা দাশ এবং রাইখালী বাজারের বকুল বালার সাথে, তাঁরা সকলে জানান বিগত ৩০ বছরেরও অধিক সময় ধরে তাঁরা মনসা পুঁথি এবং জাগরণ পুঁথি পাঠ করে আসছেন। তাদের সাথে ১০ থেকে ১৫ জনের মহিলা দল এবং বাদক দল থাকতো। কি যে আনন্দ পেতাম। বর্তমানে আগের মতো সেই পুঁথি পাঠ হয় না। হলেও সীমিত পরিসরে দুই একটি বাড়ীতে পুঁথি পাঠের আসর বসে।
বর্তমান প্রজন্মের কাপ্তাইয়ের বাউল শিল্পী বসুদেব মল্লিক এবং গীতা শিক্ষক অনিন্দ্য পাল জানান, শ্রাবন মাস জুঁড়ে বিভিন্ন গানের সুরে পুঁথি পাঠ করা হয়। যেমন ধর্মীয় গান-জয় জগদীশ, ভব সাগর তারন, বৃন্দাবনে চল,রাধা বিচ্ছেদের গান, নিমাই সন্ন্যাসের গান এবং বিভিন্ন আধুনিক গান যেমনঃ আষার শ্রাবণ মানে নাতো মন, অশ্রু দিয়ে লিখা এই গান, আঞ্চলিক গান-ওরে সাম্পানওয়ালা, ও সুজন সখিরে, মধু কই কই বিষ খাওয়া লা, ওরে কালা ভ্রমরা, আইজকাল আই আইলে এন কা গরর এই গান সহ বর্তমানে বহুল প্রচারিত অনেক গানের সুরে পুঁথি পাঠ করা হয়। পূর্বের বছর গুলোতে আমরা মনসা পুঁথির পাঠে অনেক অনুষ্ঠান করেছি কিন্তু এখন আগের মতো পুঁথি পাঠ তেমন হয় না।
আর্ন্তজাতিক খ্যাতি সম্পন্ন লোক কবি চট্টগ্রামের বাসিন্দা কবিয়াল কল্পতরু ভট্রাচার্য্য ও বিশিষ্ট কীর্তনিয়া প্রফুল্ল রন্জন শীল জানান, মনসা পুঁথি আমাদের লোক সংস্কৃতির একটি অংশ। শ্রাবন মাস জুঁড়ে সনাতন পল্লী গুলোতে মনসা পুঁথি পাঠের আসর বসতো। কিন্ত যুগের হাওয়ায় এখন সব কিছু বদল হয়ে গেছে। পুঁথি পাঠ বলে একটা লোকজ সংস্কৃতি আছে, বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই জানে না।