শুক্রবার , ১৩ মে ২০২২ | ১৮ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. জাতীয়
  2. রাঙামাটি
  3. খাগড়াছড়ি
  4. বান্দরবান
  5. পর্যটন
  6. এক্সক্লুসিভ
  7. রাজনীতি
  8. অর্থনীতি
  9. এনজিও
  10. উন্নয়ন খবর
  11. আইন ও অপরাধ
  12. ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী
  13. চাকরির খবর-দরপত্র বিজ্ঞপ্তি
  14. অন্যান্য
  15. কৃষি ও প্রকৃতি
  16. প্রযুক্তি বিশ্ব
  17. ক্রীড়া ও সংস্কৃতি
  18. শিক্ষাঙ্গন
  19. লাইফ স্টাইল
  20. সাহিত্য
  21. খোলা জানালা

চাকরির শেষ বয়সে মামলার বোঝা টানছেন মানবিক ডাক্তার শহীদ তালুকদার; হলো না পদোন্নতি

প্রতিবেদক
হিমেল চাকমা, রাঙামাটি
মে ১৩, ২০২২ ৬:৫০ অপরাহ্ণ

চাকরী জীবনের শেষ বয়সে এসে মামলার বোঝা টানছেন পাহাড়ের মানবিক ডাক্তার হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ডাক্তার শহীদ তালুকদার। সরকারী দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে দুদক মামলার জাল জড়িয়ে দেয় শহীদ তালুকদারের গায়ে। আর এ মামলা চলছে  বিগত ৩ বছর ধরে। কবে এ মামলা নিষ্পত্তি হবে জানে না কেউ।

সম্প্রতি দুদক শহীদ তালুকদারকে অভিযুক্ত করে এ মামলার চার্জশীটও আদালতে জমা দিয়েছে। বিচারের জন্য এখনো চার্জ গঠন করেনি আদালত। চার্জ গঠনের শুনানী আগামী ১৭ মে ধার্য করা হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৩ সালে ১৪ আগষ্ট জেলা  স্বাস্থ্য বিভাগের ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণীর ১২টি পদে ৪০টি আসনে আবেদন চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ।

আবেদনগুলো বাচাইয়ে তৎকালীন জেলা পরিষদের সদস্য বীর কিশোর চাকমাকে প্রধান, পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহমান তরফদার, খাগড়াছড়ি সদর উপজেলা   স্বাস্থ্য :ও প: প: কর্মকর্তা শহীদ তালুকদার এবং খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জন নারায়ন চন্দ্র দাসকে সদস্য করে  ৪ সদস্যর উপ কমিটি (আবেদন পত্র বাচাই কমিটি) গঠন করে জেলা পরিষদ।

আবেদন পত্র বাচাইয়ের সময় পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহমান তরফদার বিদেশে থাকায় তার পরিবর্তে আবেদনপত্র বাচাইয়ে দায়িত্ব পালন করেন পরিষদের তৎকালীন প্রশাসনিক কর্মকর্তা প্রিয় কুমার চাকমা।

এ কমিটি ১০০২টি আবেদন থেকে ৯৪৫ জনের আবেদন বাচাই করে সে বছর ২১ অক্টোবর নিয়োগ কমিটির কাছে পেশ করে। নিয়োগ কমিটি  এ তালিকার বাইরে আরেকটি তালিকা করে ৯৪৫ জনের বিপরীতে ৯৫৫ জনকে প্রবেশপত্র ইস্যু করে।

বিজ্ঞপ্তিমুলে প্রার্থীরা আবেদনের সময় সনদগুলোর ফটোকপি জমা দেয়। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণের পর মৌখিক পরীক্ষায় মুল সনদ উপস্থাপন করবে। কিন্তু  সব বাঁধা পেরিয়ে ভুয়া সনদে ফার্মাসিস্ট পদে নিয়োগ পায় উদয়ন চাকমা এবং  সুমন চাকমা।

তারা চাকরিতে যোগ দিলে তাদের ভুয়া সনদে চাকুরী হয়েছে অভিযোগ তুলে মিন্টু চাকমা নামে এক ব্যাক্তি খাগড়াছড়ি সিভিল সার্জনকে অভিযোগ দেয়। সেখানে আঞ্চলিক পরিষদের এক সদস্য এবং সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রধান সহকারী ও হিসাব রক্ষক কালি রতন চাকমার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়।

এ অভিযোগের ভিত্তিতে  শহীদ তালুকদারকে প্রধান করে ৩ সদস্যর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেন সিভিল সার্জন। এ কমিটি তদন্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দেয়।

এতে শহীদ তালুকদার লিখেন উদয়ন চাকমা এবং সুমন চাকমার ডিপ্লোমা ফার্মেসীর সনদের অস্থিত্ব মিলেনি। সনদগুলো কালি রতন চাকমার কাছে সংরক্ষিত থাকার কথা। কিন্তু তার কাছে পাওয়া যায়নি। তদন্তকালে কমিটির সামনে অসংলগ্ন কথাবার্তা বলেছে উদয়ন চাকমা। অন্যদিকে সুমন চাকমাকে তদন্তে হাজির হতে ২ বার নোটিশ দেয়া হলেও সে হাজির হয়নি। কালি রতন চাকমার বিরুদ্ধে অনিয়মের সংশ্লিষ্টতা থাকায় তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি  উচ্চতর তদন্তের সুপারিশ করে তদন্ত কমিটির প্রধান শহীদ তালুকদার।

এ তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে  ২০১৫ সালে ১৮ জানুয়ারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চাইথোঅং কে লিখিতভাবে জানায় সিভিল সার্জন।

এতে বলা হয়, অভিযুক্ত দুজনের ফাইল তলব করা হলে কালি রতন চাকমা উপস্থাপন করতে পারেনি।  কালি রতন দায়িত্ব অবহেলা করেছেন। এ তদন্তের আগে কালি রতন বলেছিল দুজনের কাগজ ঠিক আছে। এ অপরাধে কালি রতনের বেতনও বন্ধ রাখা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদন প্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে ২৫ ফেব্রুয়ারী জেলা পরিষদ চেয়ারম্যানের সভাপতিত্বে পরিষদের সভাকক্ষে নিয়োগ কমিটির এক সভা অনুষ্ঠিত হয়।

সভায় জেলা পরিষদের মুখ্য নির্বাহী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন, নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রহমান তরফদার, সদস্য  মো. সাহাব উদ্দিন, সদস্য বীর কিশোর চাকমা, সিভিল সার্জন নারায়ন চন্দ্র দাস, আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য রক্তোৎপল ত্রিপুরা উপস্থিত ছিলেন।

এ সভার বিবরণী মতে,   নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি উত্থাপিত হলে এর জন্য সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কালি রতন চাকমা ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা মো.জাহেদ হোসেনকে দায়ী করে সিভিল সার্জন।

এ সভায় দায়িত্ব অবহেলার কারণে কালি রতন চাকমাকে জরুরী ভিত্তিতে  দুর্গম উপজেলা লক্ষীছড়িতে বদলী এবং মো.জাহেদ হোসেনকে সর্তক করার সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

কিন্তু ভুয়া সনদে চাকুরি পাওয়া দুজনের পক্ষে অবস্থান নেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য রক্তোৎপল ত্রিপুরা। অভিযুক্ত উদয়ন চাকমা ও সুমন চাকমাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে তাদের নিয়মিত করার পরামর্শও দেন রক্তোৎপল ত্রিপুরা।

কিন্তু নিয়োগ কমিটির কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ না দিয়ে আবেদন বাচাই  কমিটির সবাইকে আসামী করে ২০১৮ সালে ৩০ জানুয়ারী দুদক সমন্বিত রাঙামাটি কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক সৈয়দ নজরুল ইসলাম খাগড়াছড়ি মডেল থানায় সদর মামলা করেন। তখন রাঙামাটি সিভিল সার্জন ও রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের প্রকল্প পরিচালক ছিলেন শহীদ তালুকদার। মামলার অন্য আসামীরা ছিল ভুয়া সনদে নিয়োগ পাওয়া ফার্মাসিস্ট উদয়ন চাকমা  এবং সুমন চাকমা।  দুদক চার্জশীট জমা দেওয়ার পর জামিনে থাকা উদয়ন ও সুমন চাকমা জামিন বাতিল করে কারাগারে পাঠায় আদালত।

অনুসন্ধানে দেখা যায়,

নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির ১০ নম্বর শর্তে উল্লেখ ছিল আবেদন পত্রে কোন অসত্য তথ্য পরিবেশন করলে কাগজপত্রাদি ভ্রান্ত মর্মে প্রতিপন্ন হলে নিয়োগের যেকোন পর্যায়ে আবেদন পত্র/ নিয়োগ বাতিলসহ সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু উদয়ন ও সুমন নিয়োগ পাওয়ার পর তারা ভুয়া সনদে চাকুরী পেয়েছেন তা প্রমাণিত হলেও নিয়োগ কমিটি তথা জেলা পরিষদ তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।

মামলার বিষয়ে ডা. শহীদ তালুকদার বলেন,

আমি মুল নিয়োগ কমিটির সদস্য ছিলাম না। আমার কথায় কারোরই চাকুরী হয়নি। চাকরী দেওয়ার মত আমি কেউ ছিলাম না। আমাদের আবেদনপত্র যাচাইয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল মাত্র।   আমাদের মুল সনদ দেখার সুযোগ ছিল না। আবেদন পত্রের প্রাথমিক বাচাই  করে তা নিয়োগ কমিটিকে জমা দেওয়ার পর আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়।  যাঁরা চাকুরি দিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই আনেনি দুদক। এ ছাড়াও এ নিয়োগে অভিযোগ উঠলে আমাকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। অভিযোগের সত্যতা পেয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লিখিত সুপারিশ করেছিলাম।  কিন্তু এর কোন কিছু তদন্ত না করে আমাকে আসামী করা হল।

এ মামলার কারণে আমার ক্যারিয়ারে বিরাট ক্ষতি করা হয়েছে। আমি এতদিন পরিচালক পদে পদোন্নতি পেতাম। আমার ব্যাচম্যাট সবার এ পদোন্নতি হয়েছে। এ পদোন্নতি পেলে আমি পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রথম পরিচালক হতাম।  আমি আগামী বছর ৩০ জুন চাকুরী থেকে অবসরে যাব। এ মামলা নিষ্পত্তি না হলে আমি আর পদোন্নতিই পাব না। এ মামলা নিষ্পত্তি হলে হয়ত আমি আমার চাকুরী জীবনের শেষ বয়সে পরিচালক পদে পদোন্নতি পাব। এতদিন মানবসেবা করে আসলাম। যদি পরিচালক হতে না পারি আমার জীবনের শেষ আশা অপুর্নতা থেকে যাবে।

সিনিয়র আইনজীবী রাঙামাটি বার এসোসিয়েশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক তোষন চাকমা বলেন,

যারা চাকুরী প্রদান করেছে এবং প্রত্যক্ষভাবে যারা নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিল তাদের কাউকে আসামী করা হয়নি। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা চাকুরি দেওয়ার কেউই ছিল না। এতে বুঝা যায় যথাযথ তদন্ত না করে মামলাটি করা হয়েছে। এ দায় তদন্তকারী এড়াতে পারে না।

এ ব্যাপারে খাগড়াছড়ি দুদকের আইনজীবী সুপাল চাকমা বলেন,

মামলার অন্য আসামীদের কথা বলব না। ডাক্তার শহীদ তালুকদের সব কাগজপত্র দেখেছি। দেখে বুঝেছি সে আসলে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। ভগবান সমতুল্য একজন মানুষকে এ মামলার আসামী করা হয়েছে। কারণ তিনি এ ঘটনায় কোনভাবে দায়ী ছিলেন না। কাগজপত্রগুলো আদালতে উপস্থাপন করলে বিজ্ঞ আদালত তাকে দায় মুক্তি দিতে পারে। কারণ তিনি  একেবারে নির্দোষ।

এ মামলার ১ম আসামী নারায়ন চন্দ্র দাস ২০১৮ সালে ২৭ নভেম্বর আত্মহত্যা করেন। তাঁর স্ত্রী ডা. প্রনতি দাশগুপ্ত বলেন, মামলার পর আমার  স্বামী খুব মানসিক যন্ত্রনায় ভুগতেন। একাকী থাকতেন। কারোর সাথে কথা বলতেন না। সেদিন বাসায় সুযোগ পেয়ে ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে আত্মহত্যা করেন।

২০১৪ সালে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ নিয়ে যখন পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তপ্ত তখন সততা, গ্রহণযোগ্যতা, অসাম্প্রদায়িক ব্যক্তিত্বের বিবেচনায় সরকার শহীদ তালুকদারকে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়। যার পদ মর্যাদা হবার কথা উপ পরিচালক, সহকারী পরিচালক, পরিচালক। কিন্তু শহীদ  তালুকদার সে সময় ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তা পদ মর্যাদায়। পরবর্তীতে ২০১৭ সারে শহীদ তালুকদার সহকারী পরিচালক হয়ে পদোন্নতি পেয়ে রাঙামাটি সিভিল সার্জনের দায়িত্ব পালন করেন। টানা তিন বছর তিনি রাঙামাটি সিভিল সার্জন ছিলেন।

এ ব্যাপারে রাঙামাটির সাবেক সিভিল সার্জন ডা. স্নেহ কান্তি চাকমা বলেন, শহীদকে সরকার যখন রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয় তখন পাহাড়ের তার চেয়েও অনেক সিনিয়র ডাক্তার ছিলেন। মুলত শহীদের গ্রহণযোগ্যতা, সততার কারণে সরকার তাকে নিয়োগ দেয়।

 

 

সর্বশেষ - আইন ও অপরাধ

%d bloggers like this: